ভাষা মতিন আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর হৃদয় নিংরানো দুঃখগাথা লেখা আমাদের হৃদয়ে এখনো দাগ কাটে। ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পুর্তে তার লেখা প্রবন্ধটি শাহজাদপুর সংবাদ ডট কম এ পুনঃ প্রকাশ করা হলো।
আবদুল মতিন-
আমার জীবনটা অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ১৯৩৩ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে আমার মা মারা যান। বাবা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। মাসিক ১৫ রুপি বেতনে দার্জিলিং জলাপাহাড় ক্যান্টনমেন্টে তিনি চাকরি করতেন। আমার মাসহ আমরা তিন ভাই সেখানেই থাকতাম। প্রকৃতি আর নানাবিধ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আমরা বড় হতে থাকি। ১৯৪৩ সালে দার্জিলিং সরকারি হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করি। তারপর আমার জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের দুবালিয়া গ্রামে ফিরে নদীতে হাল বাওয়া, ক্ষেতে নিড়ানি দেওয়া, সাঁতার ইত্যাদি শিখি। তখন কৃষক হওয়াই ছিল আমার একমাত্র ইচ্ছা। এক সময় নদীভাঙনে আমাদের দুবালিয়া গ্রাম হারিয়ে যায়।
১৯৪৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকায় চলে আসি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পাসকোর্সে ভর্তি হই। থাকতাম ফজলুল হক হলের পাঁচ নম্বর কক্ষে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক মাস পর একদিন শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের হলে আসেন। তিনি এক ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দেন। ১৯৪৮ সালে আমরা 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' গঠন করি। ১৯ মার্চ পাকিস্তানের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। আমরা জানতে পারি তিনি ২১ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বক্তৃতা দিলেন। তার সম্পর্কে আমার আস্থা উঠে গেল। ২২ মার্চ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। সেখানে প্রধান অতিথির ভাষণে জিন্নাহ সাহেব রেসকোর্সের ভাষণের পুনরাবৃত্তি করে ঘোষণা দেন 'উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করে বলি 'নো, নো'। সঙ্গে ওই সভার প্রায় সবাই একবাক্যে আওয়াজ তুললেন 'নো, নো'।
১৯৪৯ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হই। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল কর্মচারী বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন শুরু করে। আমরা তাদের পক্ষে সমর্থন দেই। আমরা মিছিল বের করে সচিবালয়ে যাই মন্ত্রীর কাছে দাবি পেশ করার জন্য। পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। আমি পুলিশের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হই। ওইদিন আমাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। মিছিল করার জন্য দুই মাসের ডিটেনশন দিয়ে ঢাকা কারাগারে পাঠানো হয়। আমি গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন আগে সিএসপি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। একদিন জেলে আমাকে জানানো হলো আমি সিএসপি কোয়ালিফাইড হয়েছি। ঢাকা কারাগারের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ মুজিবসহ আমরা সবাই ছিলাম। আমাকে নিয়োগপত্রে সই দিতে বলা হলো। পত্রটির এক জায়গায় লেখা ছিল 'আই শ্যাল সার্ব এনি গভর্নমেন্ট দ্যাট কামস্ টু পাওয়ার মোস্ট ওবিডিয়েন্ট অ্যান্ড সাবসার্বিয়েন্টলি।' এ লাইন পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নেই সিএসপিতে যোগ দেব না। জেল থেকে বের হওয়ার পর ঢাবির ভিসি ড. মুয়াজ্জেম হোসেন আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে বন্ডে সই করতে বলেন। আমি বন্ডে সই না করায় তিন বছরের জন্য আমাকে বহিষ্কার করে দিলেন। আমি আবার সিরাজগঞ্জে ফিরে গেলাম।
১৯৫০ সালে একবার ঢাকায় এলাম। একদিন আমি ফজলুল হক হলের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে ব্যারাকে একটি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি, তখন কিছু লোকজন দোকানে বসে বলছিল_ আরে ভাই ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করল, ৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন। এতবড় আন্দোলন, আমরা তাদের সমর্থনে মিছিল করলাম। সেটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্ররা এ নিয়ে আর কোনো কথা বলছে না। কথাগুলো শুনে আমার গা শিউরে উঠল। আমি একটি পথনির্দেশনা পেলাম।
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পালন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের আমতলায় একটি সভা হচ্ছিল। অনেকের বক্তৃতা শোনার পর আমি সভাপতির অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। তিনি সংক্ষেপে কথা বলার অনুমতি দিলেন। আমি বললাম, যে কোনো মূল্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলে আমাদের মর্যাদা বাড়বে। এ কথা বলার পর সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন দিল। তখনই আমাকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজের ওপর আস্তা ফিরে পেলাম। একদিন সংগ্রাম কমিটির নামে আমি নিজে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করি। প্রস্তাবটি হলো_ 'বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকায় পতাকা দিবস উদযাপন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।' প্রস্তাবটি নিয়ে আমি দৈনিক অবজারভার অফিসে যাই। পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক মাহবুব জামাল জাহেদীকে এটি ছাপানোর অনুরোধ করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'মিটিং ঠিক হয়েছে তো?' আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। এরপর ১১ এপ্রিল আমি স্মারকলিপি লিখেছিলাম। কিন্তু ১৯৫২ সালের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত ভাষার ব্যাপারে কোনো তৎপরতা ছিল না। তবে ১৯৫০-৫১ সালে ভাষার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যাপক তৎপরতা ছিল।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। এ বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি প্রতীকী ধর্মঘট আহ্বান করে। ওইদিন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল। মিছিল শেষে কলাভবনের সামনে বিরাট এক সমাবেশ হয়। সে সমাবেশে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে আমি ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করি। আমাদের কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হয়। ৩০ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, গাজীউল হক, আহমেদ রফিক, মুর্তজা বশীর, রফিকুল ইসলামসহ বহু মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা যারা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তাদের অনেকেই চেয়েছিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে সরকারের আদেশ মেনে চলতে। এক পর্যায়ে আমরা ঠিক করলাম সরকারের আদেশ মানব না। অতঃপর ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং ২২ ফেব্রুয়ারি শফিউরের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আজ ষাট বছর পর যখন দেখি এ ভাষার বিকৃত ব্যবহার হচ্ছে তখন নিজের কাছে ভীষণ খারাপ লাগে।
সম্পর্কিত সংবাদ
৩’শ ৬০ জন দুগ্ধদাই মাতাকে ভাতা কার্ড প্রদান
শাহজাদপুর প্রতিনিধি: গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিলের আওতায় শাহজাদপুর পৌরসভা কর্তৃক বাছাইকৃত উপক...
আইন-আদালত
৪২ দিন পর সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলার চার্জশীট আমলে নিলেন আদালত
শামছুর রহমান শিশির, শাহজাদপুর থেকে : আজ মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে সংঘটিত দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর দৈনিক...
৪ ফেব্রুয়ারী সালমান, সানি লিওন আসছেন ঢাকায়
নিজস্ব প্রতিবেদক : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জয়পুরা গ্রামের নির্মাণ শ্রমিক আলামিন হোসেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে ওই গ্রামে... অনলাইন ডেস্কঃ সিরাজগঞ্জের ছয়টি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন...
পড়াশোনা
অর্থাভাবে লেখাপড়া অনিশ্চিত শাহজাদপুরের কৃতী শিক্ষার্থী আলামিনের
রাজনীতি
সিরাজগঞ্জে পৌর নির্বাচনে বিএনপি’র ৬ প্রার্থী চূড়ান্ত
