বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রয়াত ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের স্মৃতির স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে একুশের প্রবন্ধ উৎসর্গ করা হলো।

সূচনাপর্বঃ- আজ শনীবার, ৯ ফাল্গুন-১৪২১ বঙ্গাব্দ,২১ফেব্রুয়ারি-২০১৫ ইংরেজী সাল, ভাষা আন্দোলনের ৬৩ বছর পুর্তি উপলক্ষে আতেœাপোলোদ্ধির আলোকে প্রয়াত ভাষা সৈনিক (ভাষা মতিন) আব্দুল মতিনের স্মৃতির স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে এই একুশের প্রবন্ধ। ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর বুধবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান (ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। তিনি ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ধুবুলিয়া (শৈলজানা গ্রামে) জন্ম গ্রহন করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ৯ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে ভাষা মতিন ছিলেন সবার বড়। মৃত্যুর ১০ বছর পূর্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য স্ত্রী কন্যাদের সম্মতি নিয়ে তিনি তাঁর দেহটি দান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কাছে। সেখানেই চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ৫ অক্টোবর মৃত্যুর পর সন্ধানীকে চক্ষুদানের সিন্ধান্তের কথা জানান আব্দুল মতিন। মারা যাওয়ার পর তাঁর চোখ সংগ্রহ করে সন্ধানী। পরেরদিন রাজধানীর চক্ষু হাসপাতালে তাঁর দুই কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয় ইকবাল ও রেশমার চেখে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে’। কিন্তু সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের চোখ দিয়ে দুজন মানুষ দিব্য চোখেই পৃথিবীর আলো দেখছেন। কলেজ শিক্ষক ইকবাল কবির ও স্বাস্থকর্মী রেশমা নাসরীন দুই বছর আগে দৃষ্টি শক্তি হারালেও কর্নিয়ার অভাবে তারা পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের চোখে আলো দেখা দুজন মানুষই তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে এটাই প্রমানিত হলো যে মানুষ কেবল জীবিত অবস্থায়েই মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন না,মহৎ মানুষ মৃত্যুর পরেও অন্যদের অনুপ্রাণিত করে থাকেন। আমাদের সমাজে আব্দুল মতিনের মতো মানুষ যত বেশি হবে, সমাজ আক্ষরিক ও অন্তর্নিহিত অর্থে তত আলোকিত হবে। চরম সত্য এই যে,আব্দুল মতিন নিঃস্ব হয়ে যেমন পৃথিবীতে এসেছিলেন তেমনি নিঃস্ব হয়ে পৃথিবী থেকে বিদেয় নিয়েছেন। এ পৃথিবীতে তাঁর নিজ নামীয় একখন্ড জমি নেই। নেই কোন অর্থকরি কিম্বা সম্পদ। সত্যিকারের আদর্শ ও ন্যায়নীতিবান জীবন সংগ্রামের চেতনা সম্পন্ন একজন মহৎ মানুষ হিসেবে যুগযুগ ধরে মানব সমাজে তথা বাঙালির স্মৃতিপটে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। পর্যালোচনাঃ- নিজেকে জানতে পারা বা আবিষ্কার করা হচ্ছে মানুষের জন্য সবচেয়ে মহৎ এবং কঠিন কাজ। সক্রেটিস থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে সব মনীষীই আত্মপরিচয় খোঁজার জন্য মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন। আধুনিক সময়, সমাজ ও জীবনকে জানতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন এর প্রাচীনতম উৎসের সন্ধান করা। তারপর সেই উৎস থেকে ক্রমে ফিরে আসতে হবে বর্তমানে। আর এ ফেরা পথে খুঁজে নিতে হবে বিভিন্ন যুগপর্ব আর ঘটনার ধারাবাহিকতা। ঐতিহ্য-অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই জাতি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে। অতীত ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণা ক্ষয়িষ্ণু জাতিকে আশার আলো জ্বেলে উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে। অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো মূল্যায়ন করে সচেতন জাতি নিজেকে করে তুলতে পারে পরিশুদ্ধ। দুর্ভাগ্য আমাদের-সুপ্রাচীন উজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক হয়েও আমরা এ উৎস অনুসন্ধান থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি। প্রচলিত ইতিহাসগ্রন্থগুলোর অধিকাংশ রাজনৈতিক ইতিহাসের অগ্রগতিতেই আটকে আছে। সাধারণ মানুষ কখনও ইতিহাসের নায়ক হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের জীবন, তাদের সংগ্রাম, তাদের কৃতিত্ব তাই অজানা থেকে গেছে। মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি আর সভ্যতা সম্পর্কে না জানলে একটি জাতিকে চেনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে প্রকৃতই জানতে হলে আমাদের আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে হলে বেরিয়ে আসতে হবে প্রচলিত ইতিহাস চর্চার গন্ডি থেকে। প্রাচীনতম কাল থেকে এ মাটির মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা,চারিত্রিক স্বভাব,আচার-আচরণ,ধর্মবিশ্বাস-এসব কিছুর ভেতর থেকেই আবিষ্কার করতে হবে বাঙালিকে। এ আবিষ্কার পাল্টে দেবে দৃশ্যপট। দারিদ্র পীড়িত বাঙালি আজকের হতাশ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, যদি সে দেখতে পায় তার উজ্জ্বল অতীত। জাতিস্বত্ত্বার বিবর্তন ও বিকাশঃ- খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ভারতবর্ষে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল অহংকারী আর্য জাতি। কিন্তু বাংলায় আর্যদের রুখে দিয়েছিল বাঙালির বীরত্ব। তাই পরাজিত আর্যরা নিন্দা গেয়েছে বাঙালির। শুধু আর্য কেন, গ্রিক বীর আলেকজান্ডারও বিশ্বের বড় বড় দেশ জয় করে এসেছিলেন ভারতে। তার দিগি¦জয়ী সৈন্যদের একাংশ বাংলার সীমানায় এসেছিল। সেদিনও রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। আধুনিক গবেষণায় ভূতত্ত্ববিদরা জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের মূল ভূমি গঠিত হয়েছে ৭ থেকে ২৫ লাখ বছর আগে। ভূতত্ত্ববিদের ভাষায় সেটি ছিল ‘প্লায়োস্টসিন’ যুগ। তবে এ মাটিতে কত আগে থেকে আদি মানবের বাস ছিল তা নিশ্চয় করে বলা যাবে না। প্রাগতিহাসিককাল থেকে যারা বসতি গড়েছিল, আধুনিক বাঙালি কি তাদেরই উত্তরসূরি? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যখন খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল তখন কোনো কোনো পন্ডিত ভাষাতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছে ২ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব প্রতিফলিত হতে আরও প্রায় ১ হাজার বছর লেগেছে। ভাষাতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত হয়েছেন, আর্যদের বাংলায় আগমনের আগেও এ দেশবাসীর এক ধরনের ভাষা ছিল। এ ভাষার কিছুটা ছিল অষ্ট্রিক এবং কিছুটা ছিল দ্রাবিড়। এর সঙ্গে দেহ লক্ষণও বিচার করা হয়েছে। দেখা গেছে, বাঙালি জাতি উত্তর ভারতের জাতিগুলো থেকে একেবারেই আলাদা। মানুষের উৎস অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে আরও কিছু তথ্য উপস্থাপন করা যায়। উত্তর ভারতে প্রাচীনকালে যে আর্য জাতি এসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, নৃতত্ত্বের ভাষায় তারা ‘নর্ডিক’ জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। তারাই রচনা করেছিল ঋগবেদ। উচ্চ শ্রেণীর বাঙালির মধ্যেও আর্যভাষা ও আর্যধারার লক্ষণ দেখা যায়, তবে অবশ্যই তারা নর্ডিক গোত্রভুক্ত নয়। এ ভিন্নতার কারণেই বাঙালির এ শ্রেণীকে নৃতাত্ত্বিকরা বলেছেন ‘আলপীয়’। মাথার আকৃতি বিচারে এ দুই গোত্রকে চেনা সহজ। নর্ডিকদের মাথা হয় লম্বা আর আলপীয়দের চওড়া। তবে আলপীয়রা নির্ভেজাল বাঙালি নয়। তারা বহিরাগত। এ ভূখন্ডে এসে বসতি গেড়েছে। কিন্তু একটি বিরান অঞ্চলে এসে তারা বসবাস শুরু করেনি। এখানে আগে থেকেই মানুষের বসবাস ছিল। এ কারণেই বাঙালির উৎস অনুসন্ধানে তাদের খোঁজ পাওয়া জরুরি। আর্যরা উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার সময় যাদের পরাজিত করেছিল তাদের বলা হয় ‘দ্রাবিড়’। নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা, এই দ্রাবিড়দের চেয়ে প্রাচীন হচ্ছে বাংলার আদি অধিবাসীরা। এ প্রাচীনতম অধিবাসীদের নৃতত্ত্বের ভাষায় বলা হয় ‘অস্ট্রলয়েড’ বা ‘অস্ট্রিক’। এ নাম গ্রহণের পেছনে নৃতত্ত্ববিদদের যুক্তি রয়েছে। তাদের মতে, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে এ প্রাচীন বাঙালিদের দেহগত মিল আছে। রক্তের গ্রুপেও এদের অনেক ক্ষেত্রে অভিন্ন। নৃতত্ত্ববিদরা অনুমান করেন, অস্ট্রিক গোত্রের মানুষদের আদিবাস ছিল ভারতে। প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে তাদের বংশধররা অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার এ আদি গোত্র অস্ট্রিককদের সঙ্গে ক্রমে মিশ্রণ ঘটতে থাকে দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষদের। আলপীয়দের আসার অনেক আগেই বাংলায় এসে পৌঁছেছিল দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষ। সুতরাং অনুমান করা সহজ, একটি দীর্ঘ মিশ্রণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তার চূড়ান্ত রূপ অর্জন করে। এ চূড়ান্ত রূপটি তৈরি হয় প্রধান তিনটি গোত্রীয় মিশ্রণের মাধ্যমে- এগুলো হচ্ছে অস্ট্র্রিক, দ্রাবিড় আর আলপীয় গোষ্ঠী। ভাষাতত্ত্ববিদরা বাংলা ভাষার নির্যাস থেকেও এর সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন। তারা বাংলা ভাষার ভেতর পেয়েছেন অস্ট্রিক, দ্রাবিড় প্রভৃতি ভাষার অনেক শব্দ। ‘অসুর’ নামে একটি জাতির কথা জানা যায় বৈদিক ও পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে। কারও কারও মতে আর্য-পূর্ব যুগের স্থানীয় অধিবাসীরা এ অসুর। যোদ্ধা আর্যদের প্রবেশের অনেক আগেই এ দেশে তাদের বসতি ছিল। তারা কৃষি ও গো-পালনের মধ্য দিয়ে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। ‘হরিবংশ’ নামের এক প্রাচীন সিংহলী গ্রন্থের কাহিনীতেও এ সত্যের আভাস রয়েছে। বলা হয়েছে, পুরুবংশে বলি নামে এক রাজা ছিলেন। এ রাজার ছিল পাঁচ পুত্র। তাদের নাম ‘অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম ও পুন্ড্র’। এরা পাঁচটি রাজ্য শাসন করতেন। তাদের নাম থেকে রাজ্যগুলোর নামকরণ হয়েছে। বাংলায় আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকেই যে জনবসতি ছিল তা আর্যগ্রন্থ থেকেও জানা যায়। এভাবে আলোচনার প্রান্তিকে এসে বলা চলে অস্ট্রলয়েড বা অস্ট্রিক নৃতাত্ত্বিক ¯্রােত থেকে বাঙালি জাতিসত্তার যে বিকাশ ঘটেছে, তাতে মিশ্রণ ঘটেছে অনেক জাতিগোষ্ঠীর রক্তধারার। এ মিশ্রণ অব্যাহত ছিল মধ্যযুগব্যাপী। মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে তুর্কি, পাঠান রক্তধারার মিশ্রণ ঘটেছে এ জাতিসত্তার মধ্যে। এ মিশ্রণ ছিল এতই স্বতঃস্ফূর্ত যে, একে আর আলাদা করার উপায় থাকেনি। প্রতিটিই গ্রন্থিত হয়েছে একই সুতোয়। আর অভিন্ন পরিচয় পেয়েছে এ দেশবাসী। এভাবেই সে হয়েছে গর্বিত বাঙালি। ভাষা রক্ষার পূর্বাপর ইতিহাসঃ- পরিবর্তনের পথ মাড়িয়ে বাংলা ভাষা এক সময় তার নিজস্ব অবয়বে এসে দাঁড়ায়। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হিসেবে ‘চর্যাপদ’ নামের পুঁথিকে নির্দেশ করা হয়। এই অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে পাল শাসন যুগে। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারে সংস্কৃত পুঁথি খুঁজতে গিয়ে এই বিস্ময়কর আবিষ্কারটি করেন। ২২ জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের ৪৭টি চর্যাপদ ও তার সঙ্গে আরও তিনটি পুঁথি পেয়েছেন তিনি। এসব থেকে অনুমান করা হয় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চর্যাপদ লেখা শুরু হয়েছিল। আদি মধ্যযুগের বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে চন্ডীদাসের লেখা কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’। আর শেষ মধ্য পর্যায়ের নিদর্শনগুলো হচ্ছে কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, কবি কঙ্কনের ‘চন্ডীমঙ্গল’, কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, কবিচন্দ্রের ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’, ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গল’, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ইত্যাদি গ্রন্থ। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ নির্দিষ্ট হয়েছে। সাধারণভাবে মনে হতে পারে বাংলাদেশে বসবাসকারীরাই বাঙালি। অন্তত আদিকাল থেকে যারা বসবাস করছে। কিন্তু খুব সহজে এমন উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না। কারণ এ ভূখন্ডটি অনেক পুরনো। আর বাংলা বা বাংলাদেশ নামের অঞ্চলটি চিহ্নিত হয়েছে অনেককাল পর। সুতরাং বোঝা যায় ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে এসে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একশ্রেণীর মানুষ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের উত্তরাধিকারী হিসেবেই আমাদের সরব অবস্থান। এটি ঠিক যে, বাঙালিকে খুঁজে পাওয়া যাবে বৃহত্তর বাংলার ভৌগোলিক পরিমন্ডলে। তার উৎস বহির্বঙ্গে নয়। তাহলে এই যে যুগে যুগে নানা জাতি-বর্ণের আগমন, তাদের মধ্যে বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত হবে কারা? সাধারণভাবে একটি সমাধান তৈরি করা যায়, তা হচ্ছে- নানা রক্তের মিশ্রণ থাকলেও বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারাই হবে বাঙালি। অনেক পন্ডিতই ভাষাতত্ত্বের বিচারে বাঙালিকে শনাক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে করে এক ধরনের সমস্যার নিষ্পত্তি সম্ভব হলেও উৎসে পৌঁছায় নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। লিখিত অবস্থায় বাংলা ভাষা নিজস্ব অবয়বে দাঁড়িয়েছে আট শতকের পর থেকে। নয়-দশ শতকে সুনির্দিষ্ট রূপ পেয়ে যায় বাংলা ভাষা। এ সময় থেকে বাংলাভাষী যে জনগোষ্ঠীকে পাওয়া যাচ্ছে, তাদের না হয় বাঙালি বলে নির্দিষ্ট করা গেল, কিন্তু তারাও তো কারও উত্তরাধিকার! এ পূর্বসূরিদের খুঁজে পাওয়া গেলেই বাঙালির উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। রক্ত ও বর্ণের বিচারে নিরেট কোনো উৎস থেকে বাঙালিকে আবিষ্কার করা যাবে না। একটি সংকর জাতি-বর্ণের বিকাশ ঘটেছিল এ মাটিতে। জনমিশ্রণের এমন উদাহরণ উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরলই বলা চলে। আর্য আগমনের পর থেকে যুগে যুগে বহির্বঙ্গের অনেক রাজারাজড়া বাংলা আক্রমণ করেছেন। এক সময় তারা ফিরেও গেছেন। কিন্তু সঙ্গে আসা সৈন্য সামন্ত বা লোকলস্করের কেউ কেউ এ মাটির আকর্ষণে থেকে গেছেন। সৈন্য হিসেবে অথবা রাজকর্মচারী হিসেবে চাকরি করার সুবাদেও অনেকে বাংলার স্থায়ী অধিবাসী হয়েছেন। কিন্তু এই অভিবাসীরা সংখ্যায় এত বেশি ছিল না যে, এদেশের আদি আধিবাসীদের তারা গ্রাস করতে পারে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে তারা এত প্রবল ছিল না যে, এদেশবাসীকে বহির্বঙ্গীয় সংস্কৃতির বন্ধনে বন্দি করে ফেলতে পারে। তবে প্রাচীনতমকাল থেকেই তাদের রক্তপ্রবাহ এদেশের জাতি গঠনে সঞ্চারিত হয়েছে। জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির জন্য ভৌগোলিক সীমারেখা যথেষ্ট নয়; ভাষা সম্পর্কে সচেতনতাই হচ্ছে প্রধান। নয়-দশ শতকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হলেও এ ভূখন্ডে আরও অনেককাল আগে থেকেই বিভিন্ন জাতির আগমন ও মিশ্রণ ঘটেছিল। বাংলা ভাষাভাষী মানুষকেই যদি বাঙালি বলে চিহ্নিত করা যায় তাহলে এই জাতিগোষ্ঠীকে বাঙালি জাতির আদিধারা না বলার কারণ নেই। কারণ বাংলা ভাষার সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ নয়-দশ শতকে প্রকাশিত হলেও তার ভ্রুণ-শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাবে আরও অনেককাল আগে। পাল শাসন যুগে বাঙালির আত্মপরিচয় যেমন স্পষ্ট হচ্ছিল, সেন শাসন যুগে বিশেষ করে বারো শতকে বাঙালিত্বের এই প্রতিষ্ঠায় আসে আঘাত। বিদেশী ব্রাহ্মণ শাসক সেনদের মধ্যে ছিল ঔপনিবেশিক চরিত্র। বাঙালির রাজ্যপাট ব্রাহ্মণ শাসক সেনদের মধ্যে ছিল ঔপনিবেশিক চরিত্র। বাঙালির রাজ্যপাট গ্রাস করায় বাঙালির প্রতি এক ধরনের মানসিক ভীতি ছিল তাদের। তাই বিভিন্ন বিধি আরোপ করে কণ্ঠরোধ করতে চাইল বাঙালির। কৌলীন্য প্রথা প্রয়োগ ও বর্ণ-বিভাজন করে সামাজিক জীবনের ঐক্যকে ভেঙে ফেলতে চাইল। ভাষার কণ্ঠ রুদ্ধ করে বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলল। সাধারণ বাঙালির বিদ্যাশিক্ষা নিষিদ্ধ হল। ঘোষণা করা হল শাস্ত্রচর্চা করবে শুধু ব্রাহ্মণরা। দেবভাষা সংস্কৃতই হবে শিক্ষার বাহন। বাংলা ভাষায় শাস্ত্র চর্চাকারীর স্থান হবে ‘রৌরব’ নরকে। তাছাড়া সামাজিক শান্তির বিধান তো ছিলই। এভাবে ‘বাঙালির’ চূড়ান্ত রূপ তৈরি হওয়ার আগেই বাঙালির অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন হচ্ছিল। লড়াকু বাঙালি যাতে সেনদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করতে পারে সেজন্য সুচতুরভাবে বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠা করলেন সেন শাসকরা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারভাগে ভাগ করে ফেলা হল এদেশের মানুষকে। বহিরাগত শাসক ও পুরোহিত ব্রাহ্মণ এবং সেনাপুরুষ ক্ষত্রিয়রা সমস্ত সুখ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার পেল। আর টাকা-পয়সা আছে বলে বণিক ও বড় ভূস্বামীরা বৈশ্য বর্ণভুক্ত হয়ে কিছুটা সুবিধাভোগী হল।অন্যদিকে বাংলার আমজনতা- প্রতিবাদী ভূমিকা রাখবে যারা- তাদের সব ধরনের অধিকার বঞ্চিত করে শূদ্র অভিধায় বিপন্ন করে তুলল। অবশেষে বাঙালি বেঁচে গেল অথবা বলা যায় টিকে গেল মুসলিম আগমনের ধারাবাহিকতায়। বাঙালি জাতির জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অভিষেক। বহির্বঙ্গীয় শুধু নয়- বহির্ভারতীয় মুসলমান শাসকরা তাদের কর্মভূমিকার মধ্য দিয়ে অচিরেই বাঙালি হয়ে গেলেন। বাঙালি জাতি গঠনে পেল নতুন মাত্রা। এই গুরুত্বপূর্ণ আখ্যাটি তৈরি হল প্রধানত ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২০০ বছরের কালপরিসরে। এর যৌক্তিক কারণ ছিল। এ সময় দিল্লিতেও প্রতিষ্ঠিত ছিল মুসলমানদের সালতানাত। বাংলার মুসলমান সুলতানরা দিল্লির মুসলমান সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়েছিলেন। বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য মুসলিম শাসিত প্রদেশ ছিল দিল্লির অনুগত। তাই দিল্লির আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে সুলতানদের ভরসা রাখতে হয় বাংলার স্থানীয় আদি অধিবাসীদের ওপরেই। তাই সেন শাসকদের মতো শত্রুতা নয়, স্থানীয় বাঙালির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে প্রয়াসী ছিলেন মুসলমান সুলতানরা। সেন শাসনপর্বে ব্রাহ্মণ শাসকদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পীড়নে সাধারণ বাঙালির জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল। ঠিক এ প্রেক্ষাপটেই এগারো শতক থেকে বাংলায় ব্যাপকভাবে সুফি সাধকদের আগমন ঘটতে থাকে। তাদের উদার মানবিক আবেদন নিপীড়িত বাঙালিকে আশার আলো দেখায়। অপেক্ষাকৃত ভালো আশ্রয়ের আশায় হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর এই বাঙালিরা ধর্মান্তরিত হতে থাকে। সুলতানি শাসনপর্বে রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধর্মান্তকরণের গতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেন রাজা ও মুসলমান সুলতান উভয়েই বহিরাগত ছিলেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে ছিল বিস্তর চারিত্রিক পার্থক্য। ঔপনিবেশিক চরিত্রের কারণে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছিলেন সেন শাসকরা। আর কর্মে ও চিন্তায় মুসলমান সুলতানরা এদেশের মাটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোনো আতœরক্ষা তাদের ছিল না। এদেশের সম্পদ তাই এদেশের উন্নয়নেই ব্যয় করেছেন। এ কারণেই রাজভাষা ফারসি হলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে সুলতানদের ঐকান্তিকতার অভাব ছিল না। এভাবে মধ্যযুগে বাঙালি নতুন করে তার আত্মপরিচয় তুলে ধরল। আমাদের পেছনে ফেরা দৃষ্টি যদি নিকট অতীতে গিয়ে থামে, তবে বাঙালির স্বজাত্যবোধ ও চেতনার শক্তি খুঁজতে হয় বায়ান্নর রক্তঝরা উত্তাল দিনগুলো থেকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি যে আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছিল, সেই চেতনা পরাধীন দেশে তাকে বারবার প্রতিবাদী করেছে। এই চৈতন্যের পথ ধরে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা এসেছে। মাতৃভাষার সংগ্রামে বাঙালির ত্যাগ এতটাই মহান ছিল যে, তা অর্ধশতকের মধ্যেই আন্দোলিত করেছে বিশ্ববাসীকে। আর তাই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করায় শুধু সার্বভৌমত্বই নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক বিজয়ও যেন পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু বাঙালির এ বিজয়ের উৎস কি ১৯৫২ বা ১৯৪৮? আসলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চারণভূমি খুঁজতে হবে চৌদ্দ, পনের ও ষোল শতকে। যদি মধ্যযুগের এই কালপর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত কর্ষণ না হতো, বাঙালির সংস্কৃত চর্চার যাত্রাপথ আটকে দেয়া অচলায়তন রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় ভেঙে না যেত, তাহলে কি আটচল্লিশ বা বায়ান্নতে বাঙালি স্বজাত্যবোধে উদ্দীপিত হওয়ার মানসিক জোর পেত? মধ্যযুগে বাঙালির রাজনৈতিক জীবনে পটপরিবর্তন না হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী হতে পারত?ইতিহাসের গতিধারা পর্যবেক্ষণ করলে এটি অতিশয়োক্তি করা হবে না যে, বাংলা ভাষা সাধারণ মানুষ বা প্রাকৃতজনের কথ্য ভাষার নড়বড়ে স্থান নিয়েই হয়তো কায়ক্লেশে টিকে থাকত। পরিচর্যাহীন সে ভাষায় বড় কোনো সাহিত্য সৃষ্টি দুরাশা হতো বললেও বোধ করি অন্যায় হবে না। এ মন্তব্য করার কারণ সুস্পষ্ট। ছয় থেকে আট শতকে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যে ভ্রুণ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন, তার উজ্জ্বল বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল পাল শাসন যুগে। মনে হয়েছিল সংস্কৃত সাহিত্যের প্রবল বেষ্টনী থেকে বোধহয় বাংলা সাহিত্যের ছোট চারাটি বেরিয়ে আসবে আলোকিত মাটিতে। চর্যা গীতিকার আগে এ দেশে সাহিত্য হয় সংস্কৃত নয়তো প্রাকৃত ভাষায় চর্চা করা হতো। ধারণা করা হয়, বণিক ও সাধুসন্তদের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ পৌঁছানোর আগেই বাংলায় সংস্কৃত ভাষা প্রবেশ লাভে সক্ষম হয়েছিল। তাই সংস্কৃতকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষা বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিত না, যদি পাল রাজাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি না থাকত। প্রাচীনকাল থেকে পথপরিক্রমণ করে যদি স্বাধীন-সার্বভৌম আজকের বাংলাদেশে প্রবেশ করি, তাহলে দেখব এই ভূখন্ডের মানচিত্র রেখায় বহুবার রূপান্তর ঘটেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তিত হয়েছে অনেকভাবে। রাজদন্ডের হাত বদল হয়েছে নানা জাতির রাজন্যবর্গের কাছে। তাই রাজনৈতিক জীবনধারার উপরি কাঠামোটিকে সহজেই চেনা যায়। ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস তাই আমাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু আবহমানকালের বাঙালির যে জীবনবোধ, তার স্বাধীন সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে তীব্র আকাঙ্কক্ষা তাকে আবিষ্কার করা হয়নি তেমনভাবে। তাই একাত্তরে বাঙালির বিস্ফোরণকে ততটা সূক্ষèভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। সাধারণভাবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা খোঁজা হয় ভাষা আন্দোলনের উৎসভূমি থেকে। বলা হয়, ভাষা আন্দোলন বাঙালির মধ্যে যে চৈতন্য জাগিয়েছিল তা তাকে টেনে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু এ মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ইতিহাসের বিশ্লেষণে ভাষা আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা বলা যেতে পারে। কিন্তু উৎস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সুপ্রাচীনকাল থেকে স্বাধীনতার আকাঙ্কক্ষা আর স্বাজাত্যবোধ স্বাভাবিকভাবেই জায়গা করে নিয়েছিল বাঙালির মনে। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারা যদি অস্বীকার না করি তাহলে মানতেই হবে, আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিল পরাভব না মানা মুক্তি প্রত্যাশী বাঙালির অবধারিত পরিণতি। কারণ হাজার বছর ধরেই বাঙালি তার সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করে এগিয়েছে। ভাষা সংস্কৃতিরই বাহন,সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের বিজয় নিশানঃ- ভাষা সংস্কৃতিরই বাহন। যেসব দক্ষতা-যোগ্যতা আর ক্ষমতা মানুষকে অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা করেছে, ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ভাব-বিনিময় করতে পারছে ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি। এর কাঠামো তৈরি করেছে মানুষ নিজেদের মেধা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাই আঞ্চলভেদে ভাষার এত তারতম্য। নিজের ভাষা আর বক্তব্যকে ধারণ করার জন্য একসময় উদ্ভাবিত হয়েছে লিপির। এ কারণে অঞ্চলভেদে বর্ণমালারও এত বৈচিত্র্য। বাংলা ভাষায়ও প্রাণের উচ্ছলতা রয়েছে। তাই সৃষ্টির পর থেকেই সে পা বাড়িয়েছে সমুদ্রের হাতছানিতে। নানা জাতির ভাষা প্রবেশের জন্য সব দরজা খুলে দিয়েছে। এভাবেই যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে বাংলা ভাষা। বিবর্তিত হয়ে এ ভাষা সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের বিজয় নিশান; প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রবৃত্তির ওপর মানুষের জয়ের চিহ্ন। কিন্তু কেবল চিহ্ন বললে কিছুই বলা হয় না, কেননা সংস্কৃতি সব সময়ই অত্যন্ত জীবন্ত ও পরিব্যাপ্ত। অনেকটা পানির মতো, সহজ কিন্তু শক্তিশালী, থাকলে বোঝা যায় না, না থাকলে প্রাণ সংশয় দেখা দেয়। তাই বলা যাবে যে সংস্কৃতি শিক্ষার চেয়েও ব্যাপ্ত ও জরুরি। সংস্কৃতির স্তর দেখে মনুষ্যত্বের স্তর জানা যায়। এও জানা আমাদের যে মানুষেরই সংস্কৃতি আছে, পশুর নেই। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলনঃ- বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থান। মানুষ তার অধিকার চেয়েছে, ভাষার অধিকারই আপাতত, কিন্তু ডালিমের ভেতর যেমন অনেক অংশ থাকে, ওই দাবির অভ্যন্তরে তেমনি অনেক দাবি ছিল। মূল বিষয়টি ছিল সংস্কৃতি; সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের জন্যই রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। শুধুই যদি রাজনৈতিক আন্দোলন হতো, তবে সরকার পরিবর্তন কিংবা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। ঘটেনি। অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হওয়ার পরও একুশের আন্দোলন থামেনি। থামেনি, কেননা সংস্কৃতি এখনো মুক্ত ও উন্নত হয়নি। মনুষ্যত্ব আজও নিরাপদ নয়। সংস্কৃতির মুখ্য শত্রু কে ছিল সেদিন? ছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একগুচ্ছ শক্তির সমষ্টি, সে ছিল ভয়াবহ, ভয়ংকর, সম্পূর্ণ বৈরী। জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান ছিল একটি শোষণভিত্তিক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেখানে ক্ষমতাসীন অবাঙালিরা বাঙালিদের নিগৃহীত করবে- এটাই ছিল স্বাভাবিক। মোড়কটা ছিল ধর্মীয়, অভিপ্রায়টি নিষ্ঠুররূপে বৈষয়িক। শোষণের প্রয়োজনেই উর্দুকে চাপাতে চেয়েছে, নিষ্পিষ্ট করতে চেয়েছে বাঙালির সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতিকে কাবু করতে পারলে মানুষকে বশে রাখা সহজ। এ দেশের মানুষের জন্য রাষ্ট্র সব সময়ই ছিল শত্রুপক্ষঃ- এ দেশের মানুষের জন্য রাষ্ট্র কখনোই মিত্রপক্ষ ছিল না, সব সময়ই ছিল শত্রুপক্ষ। রাষ্ট্রের সেই বৈরী চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে ভাষার মধ্য দিয়েই। জনগণের ভাষা সব সময়ই বাংলা, শাসকদের ভাষা কখনো সংস্কৃত, কখনো ফারসি। দীর্ঘকাল ছিল ইংরেজি, পাকিস্তানিরা চাইল চাপাতে উর্দু। উর্দুর পক্ষে কেবল জিন্নাহ বলেননি, ঢাকার নাজিমুদ্দিন বলেছেন, এমনকি সোহরাওয়ার্দীও বলেছিলেন একটি বিবৃতিতে, কোনো কোনো বাঙালিও বলেছে, বলতে হয়েছে, কেননা এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী। জনগণ মানেনি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টায় রাষ্ট্রের চেহারাটি প্রকাশ হয়ে গেল। ধর্মের পোশাক আর কাজ দিল না। বাঙালি বিদ্রোহ ঘোষণা করল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বায়ান্নতে শুরু, তারপর ধাপে ধাপে এগিয়েছে, এসেছে ঊনসত্তর, এলো একাত্তর। একাত্তরের যুদ্ধ অনেক বেশি প্রচন্ড ও রক্তাক্ত, কিন্তু সূচনা বায়ান্নতেই, একাত্তর বায়ান্নরই স্বাভাবিক পরিণতি। এখনও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা অন্দোলন সংগ্রাম ও অভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু কোনোটিই ভাষা আন্দোলনের মতো সাড়া জাগায়নি বা জাগাতে পারছে না। কারণ এ সকল আন্দোলন দেশের সব মানুষের আন্দোলন কিম্বা অভ্যুত্থান নয়, যেমনটি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। এ আন্দোলন এতটাই প্রাণস্পর্শী ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের মতই এ এই আন্দোলনে পরাজয়ের কোনস্থান ছিল না।পরাজয় মানেই মৃত্যু- মনুষ্যত্বের জন্য, মানবিক সংস্কৃতির জন্য। সংস্কৃতির শক্তি প্রমাণিত হয়েছে, পুরাতন রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে সংস্কৃতির কাছে। ভাষার মতো ইহজাগতিক সত্য কম আছে। ভাষা মানুষই সৃষ্টি করে, মানুষের প্রয়োজনে ভাষা ঐক্যবদ্ধ করে মানুষকে, সেও মানুষের প্রয়োজনেই। রাষ্ট্র ভেঙেছে। কিন্তু বাংলা প্রচলিত হয়েছে কি জীবনের সর্বক্ষেত্রে? হয়নি। লেখাপড়া যারা শিখছে, তারা যে সমাজের দরিদ্র অংশের অন্তর্গত নয়, তাও বাস্তব সত্য। ওদিকে ইংরেজি শেখার জন্য এখন যে উৎসাহ জাজ্বল্যমান তেমনটি অন্য কোনো স্বাধীন দেশে আজ দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইংরেজি শেখার আগ্রহ যে কেবল ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, কম বিত্তবানরাও শিখতে চায় এবং শিখতে না পেরে নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। এ দেশে একটি বুর্জোয়া বিকাশ অবশ্যই ঘটেছে, বেশ কিছু লোক ধনী হয়েছে, দরিদ্র দেশ আরো দরিদ্র হচ্ছে এদের পুষতে গিয়ে, কিন্তু এরা বাংলা ভাষার জন্য মিত্রের কাজ করছে না। বর্তমান সংস্কৃতির ধারাটাই প্রতিক্রিয়াশীলঃ- অতীতেও সংস্কৃতির দুই ধারা ছিল, এখনো আছে। বড় ধারাটাই প্রতিক্রিয়াশীল। ওই প্রবাহ পুষ্ট হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের যৌথ তৎপরতায়। মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবছে না, পারছে না ভাবতে। ব্যক্তিগত মুনাফা ছাড়া অন্য কিছুকে বিবেচনায় আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিপরীত ধারাটি হলো ভাষা আন্দোলনের। এই ধারা আত্মসমর্পণের নয়, বিদ্রোহের। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সংস্কৃতির অপর ধারার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান। এই ধারা জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা তো অবশ্যই, যথার্থ অর্থেই গণতান্ত্রিক এবং অভীপ্সায় সমাজতান্ত্রিক। এ চায় দুর্দশগ্রস্ত বাংলাদেশে মানুষের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করতে মৈত্রীর বন্ধনে এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে । এই প্রবাহ যেমন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বে, তেমনি ছিন্ন করবে সামন্তবাদের নির্মম দুঃশাসন। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কোনো তুলনা নেই। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ শ্রেণীবৈষম্য। ওই বৈষম্য শতকরা ৯৫ জন লোককে মনুষ্যত্বহীনতার নানা স্তরে রেখে দিয়েছে, যার ফলে এই মানুষেরা উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য অপনোদনের কাজে অংশ নিতে পারছে না। মানুষের সৃষ্টিশীলতা পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে। সৃষ্টির সেই ক্ষমতাকে মুক্ত না করে আমরা কিছুতেই এগোতে পারব না। এবং সেই ক্ষমতা কিছুতেই মুক্ত হবে না, যদি না বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে একটা শ্রেণী-শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলা যায়। ভাষা আন্দোলন এ কথাটাই বলছে। নেশাগ্রস্থ মাতাল সংস্কৃতির ডামাডলে জাতিঃ- ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আমরা বাঙালিরা সবসময় প্রতিবাদ মুখর ছিলাম শোষণ নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ভাষার অধিকার আদায়ের মন্ত্রপাঠে আমরা স্বাধীনতা অর্জনে স্বক্ষম হয়েছি। কিন্ত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৩ বছর পার হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে দেয় জাতিগত ভাবে আমরা পুঁজিতন্ত্রের এক লুটেরা সংস্কৃতির ডামাডলের মধ্যে আটকে গেছি। এখানে মানুষের বিবেক ও মানবিক মূল্যবোধ কোনটাই কাজ করছে না। আমরা এক ঘৃন্য ও উশৃংখলতার অসভ্য অপসংস্কৃতির কালো অধ্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করেছি। সংস্কৃতির গুরুত্বের কথাটা আবারও স্মরণ করা যাক। একজন লোক লুটপাট, দূর্নীতি, কালোবাজারী করবে নেশাগ্রস্থ হয়ে রাস্তায় মাতলামি করবে নাকি ঘরে বসে ভালো গান শুনবে, এটি কোনো নৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত বটে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা সত্য, সমষ্টির ক্ষেত্রেও তাই সত্য। সিদ্ধান্ত ব্যক্তি নিজে নেয় এমনও বলা যাবে না, ব্যবস্থাই নিয়ে নেয়, ব্যক্তির জন্য। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দর্শন ধারা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চলমান রয়েছে। এ ধারায় সমাজতান্ত্রিক ধারার কিছুটা বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেলেও সে ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক ধারাও কি প্রতিষ্ঠা রক্ষায় সূদৃঢ় হতে পারছে? পারছে না। এ ধারা যদি মানবিকতা রক্ষার ধারা হতো তাহলে দেশে দেশে এত বিরোধ যুদ্ধ, প্রকৃতি পরিবেশের এতটা বিপর্যয় দেখা দিত না। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মারামারি হানাহানি লেগে থাকতো না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আজ যদি কোনো সংকট দেখা দিয়ে থাকে, তবে সেও ওই সংস্কৃতির কারণেই। একজনের নিজের শরীরে কোনো ভালো সার্ট নেই দেখে কাতর হবে, নাকি অন্য সবার গায়ের অবস্থা কি তার বিচার করবে- এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন, ওই সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির। সমাজতন্ত্র কয়েকজনের উৎকৃষ্ট সার্ট উৎপাদন করার পরিবর্তে সবার জন্য প্রয়োজনে নিম্নমানের হলেও সার্ট এর ব্যবসা করতে চায়। পুঁজিবাদের সঙ্গে এখানেই তার মৌলিক ব্যবধান, কেবল উৎপাদন নয়, সমবণ্টনেও সে সমানভাবে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক সমাজ যদি তার এই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষকে অবহেলা করে, পণ্য তৈরির মাপকাঠিতে নিজেকে বিচারের জন্য হাজির করে, ত??

সম্পর্কিত সংবাদ

কাল থেকে শুরু এইচএসসি পরীক্ষা, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

জাতীয়

কাল থেকে শুরু এইচএসসি পরীক্ষা, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

আগামীকাল রোববার (৬ নভেম্বর) থেকে সারা দেশে একযোগে চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।

নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা কথা

উপ-সম্পাদকীয়

নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা কথা

ঢাকার কাফরুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

মুক্তিযুদ্ধ

ঢাকার কাফরুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকার কাফরুল থানা এলাকার পার্ক (চাইনিজ) হোটেলে মহানগর মুক্তিযোদ্ধাদের এক মত বিনিময়...

ঈদান্তে বাসের ছাদে যাত্রীর ঝূঁকিপূর্ণ চলাচল! বর্ধিত ভাড়া দিতে না পারায় ছাদে ওঠার প্রবণতা বাড়ছে

দিনের বিশেষ নিউজ

ঈদান্তে বাসের ছাদে যাত্রীর ঝূঁকিপূর্ণ চলাচল! বর্ধিত ভাড়া দিতে না পারায় ছাদে ওঠার প্রবণতা বাড়ছে

শামছুর রহমান শিশির : পবিত্র ঈদ-উল-আযহা’র পরবর্তীতে বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়ক ও শাহজাদপুর-ঢাকা মহাসড়কে বাস ভাড়া আরেক দফা বেড়েছ...

ঘুষ না দেয়ায় প্রধান শিক্ষককে পেটালেন শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী!

অপরাধ

ঘুষ না দেয়ায় প্রধান শিক্ষককে পেটালেন শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী!

শাহজাদপুর প্রতিনিধি : এবার ঘুষের ৫ হাজার টাকা না দেয়ায় খোঁদ শাহজাদপুর প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী আব্দুর রশিদ কর...