মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
শামছুর রহমান শিশির : বহুমুখী কারণে দেশের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক জলসম্পদে ভরপুর বিল চলনবিল দিনদিন হারিয়ে ফেলছে তার চিরচেনা রূপ আর গৌরবময় ঐতিহ্য। পাশাপাশি বিলটি হারাতে বসেছে তার জীববৈচিত্র। চলনবিলের বিল-নদীতে ফোটে ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ নানা প্রজাতির শাপলা ফুল ও গুল্মলতা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল ও বেগুণী শাপলা ফুলের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বর্ষা মৌসুমে বিলে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় শাপলা। আবহমান কাল থেকেই শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত ছিল। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত পদ্ম মধু, শালুক আর ঢ্যাপের খই ও খইয়ের মোয়া। চলনবিলাঞ্চলের স্বল্প আয়ের অভাবী মানুষেরা বিল থেকে পদ্ম মধু, শাপলা-শালুক ও মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রকারের শাপলা। ফলে ওইসব অভাবী মানুষের অনেকেই বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে আবার অনেকেই পেশা বদলেছে। ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। ১৯৬৭ সালে এমএ হামিদ টি,কে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গঠনকালে চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৩১ দশমিক ০ কিলোমিটার। এছাড়া বিলের গভীরতা এক দশমিক ৫৩ মিটার থেকে এক দশমিক ৮৩ মিটার; সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ১৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার। জানা যায়, কয়েক বছর আগেও চলনবিলের ছয়আনিবিল, বাঁইড়ারবিল, সাধুগাড়ীবিল, সাঁতৈলবিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ারবিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরারবিল, নিহলগাড়ীবিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়িবিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়িবিল, খৈগাড়িবিল, বৃগরিলাবিল, দিগদাড়িয়াবিল, খুলুগাড়িবিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ারবিল, ধলারবিল, ধরইলবিল, বড়বিলা, বালোয়াবিল, আমদাকুরীবিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরীবিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়াবিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণেরবিল, নলুয়াকান্দিবিল, ঘরগ্রামবিল, বেরলবিল, কচিয়ারবিল, কাশিয়ারবিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, চিরলবিল, ডিকশীবিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়াবিল, আইড়মারীবিল, কৈখোলাবিল, কানচগাড়ীবিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গাবিল, মেরীগাছাবিল, খলিশাগাড়ীর বিল, পাওয়া যেত নানা প্রজাতির প্রচুর শাপলা ফুল। এছাড়া চলনবিলের আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপী (মরা আত্রাই), নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, বিলসূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা, বেহুলার খাড়িতে এখনো নানা রঙের শাপলার অপরুপ দৃশ্য দেখা যায়। শুকনো মওসুমে বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যায়। ফলে চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা গুল্মলতা ও জলজ প্রাণি । জানা যায়, সাদা বর্ণের শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল খুবই প্রিয়। বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বিল বাওড় জমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল আবাদে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ দখল ও শুকিয়ে যাওয়ার কারণে চলনবিল থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে শাপলা ফুল। এখন খাল-বিল-জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা। আগে অনেকে সৌন্দর্যের জন্য পুকুরে চাষ করতেন লাল শাপলা । এখন পুকুরে বিদেশি কার্প জাতীয় মাছ চাষ হওয়ায় বেগুণী ও লাল শাপলা বিলুপ্তির পথে। আগে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত ঢেপের খই মোয়া। এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না পদ্ম মধূ ও সুস্বাদু ঢ্যাপের খইয়ের মোয়া। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলা লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, আঁশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলোগ্রাম, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাইমেটার ৮.৪, ক্রড আমিষ ১৬.৮, ক্রড ফ্যাট ২.৮, ক্রড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ।’ অতীতকাল থেকেই শাপলার ফল দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খই ভাজা হয়। যেটি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে ঢ্যাঁপের খই নামে পরিচিত। শাপলার মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি কমে যায় তখন অভাবী মানুষ শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করে। সিদ্ধ শালুক বেশ সুস্বাদু। শাপলা চুলকানি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। ডায়াবেটিক, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনারি সমস্যা ও নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে লাল শাপলা খুবই উপকারী। কৃষিবিদগণের মতে, শাপলা ৩ প্রকারের হয়ে থাকে। সাদা বেগুণী ও লাল রঙের। এরমধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ঔষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি । সাধারন শাক-সবজির চেয়ে শাপলার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমান আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। খাল বিল জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলা জন্মানো ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে দেশে বাণিজ্যিকভাবে শাপলার চাষ হয় না বলে তিনি জানিয়েছেন।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে উৎপাদন দুধ দেশে দুধের চাহিদা মেটাচ্ছে

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে উৎপাদন দুধ দেশে দুধের চাহিদা মেটাচ্ছে

ওই বিপুল পরিমান দুধ মিল্কভিটাসহ অন্যন্য বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টার ও কারখানায় প্রক্রিয়াজাত ও শীতলীকরণের মাধ...

ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াবে বিএনপি : ফখরুল

রাজনীতি

ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াবে বিএনপি : ফখরুল

বিএনপি কখনও মাথা নত করে বসে যায়নি বলে উল্লেখ করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি য...

কোহলির সাথে বন্ধুত্বের গল্প শোনালেন ইমরুল

খেলাধুলা

কোহলির সাথে বন্ধুত্বের গল্প শোনালেন ইমরুল

ইমরুল কায়েসের কাঁধে হাত দিয়ে খোশগল্পে মশগুল বিরাট কোহলি- এই ছবিটি দেখেননি এমন মানুষ পাওয়া ভার। বাংলাদেশের ভারত সফরের সময়...

আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে মখদুম শাহদৌলা (রঃ) এর বাৎসরিক ওরশ শেষ হচ্ছে

ধর্ম

আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে মখদুম শাহদৌলা (রঃ) এর বাৎসরিক ওরশ শেষ হচ্ছে

শামছুর রহমান শিশির ও রাজীব রাসেল : আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ইয়ামেন শাহাজাদা হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.) এর...

শাহজাদপুরে সবজি গ্রামের সবজি চাষে সবজি চাষীদের ভাগ্যোন্নয়ন : শতশত কৃষক স্বাবলম্বী

অর্থ-বাণিজ্য

শাহজাদপুরে সবজি গ্রামের সবজি চাষে সবজি চাষীদের ভাগ্যোন্নয়ন : শতশত কৃষক স্বাবলম্বী

শাহজাদপুর প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার গাড়াদহ ইউনিয়নের সবজিগ্রাম পুরান টেপরি ও চরনবীপুর এ দুটি গ্রামে...

সরকারী নির্দেশ অমান্য করে কামারখন্দে সহকারী গ্রন্থাগার নিয়োগ

শিক্ষাঙ্গন

সরকারী নির্দেশ অমান্য করে কামারখন্দে সহকারী গ্রন্থাগার নিয়োগ

কামারখন্দ প্রতিনিধিঃ কামারখন্দ উপজেলার রসুলপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগার পদ...