বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

শামছুর রহমানঃ ‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন- সামান্য গ্রাম্য বালিকা রতনের মূখোচ্ছবি যেন বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। মনের ব্যকুলতা পোষ্টমাষ্টর বাবুকে আকুল করিয়া তুলিল, তিনি ভাবিলেন ফিরিয়া যাই। কিন্তু তখন পালে বাতাস লাগিয়াছে। আর ফিরিবার উপায় নাই। কিন্তু রতনের মনে কোন তত্বের উদায় হইল না। সে পোষ্ট অপিস গৃহের চারিদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা দাদাবাবু যদি কখনও ফিরিয়ে আসে’। হ্যাঁ! ঊনবিংশ শতাব্দির বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে ও বিশ্বের জ্ঞান পরিমন্ডলে ‘ভারস্যাটাইল জিনিয়াস’ (বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন) খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ছোট গল্প ‘পোষ্টমাষ্টার’-এর রতন চরিত্রটি শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদী পরিবারের কোন এক তরুণীকে ঘিরেই আবর্তিত বলে শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর দাবী। কবিগুরু’র সেই পালকি বাহক এবং রতনের উত্তরসূরী শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদী পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে চির অবহেলিত,চির পতিত,চির অপাঙক্তেয়ই রয়ে গেছে। যাদের বুক ফোটেতো-মুখ ফোটেনা, যাদের বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে- শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদি পরিবারে এমন চিত্রই বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে পালকি বাহনের পেশা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় ওই আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর প্রতিটি দিন কাটছে অতিকষ্টে। ওই আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর অনেকেই পালকি বাহনের পেশা পরিত্যাগ করে স্বল্প আয়ের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হওয়ায় তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে জীবনজীবিকার প্রশ্নে চরম অনিশ্চয়তা ও তাদের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা নেমে আসায় মানবেতর দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। ওদের মতো অসহায় হতভাগা আদিবাসী বাগদী পরিবারের প্রতি সমাজপতিদের যেন অবহেলার শেষ নেই। অবর্ননীয় দুঃখ কষ্ট বুকে লালন ও ধারণ করে ওদের দু’একজন এখনো ঐহিত্যবাহী পালকি বাহনের পেশা ধরে রাখলেও কালে ভাদ্রে তা ডুমুরের ফুল-এর মতোই (রূপক অর্থে) অনুধাবিত হচ্ছে। গতকাল সন্ধায় সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের পশ্চিমে ও কবিগুরুর শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গনের কয়েক’শ গজ পূর্বদিকে অবস্থিত আদিবাসী বাগদী পল্লী পরিদর্শনকালে আদিবাসী বাগদী পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য জানান, শাহজাদপুর জমিদারী একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারীর অংশ ছিল।১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারী নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তের টাকা দশ আনায় এই জমিদারী কিনে নেন।জমিদারীর সাথে সাথে শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। ১৮৯০ সালের দিকে শাহজাদপুরের জমিদারী দেখাশুনার কাজে তিনি শাহজাদপুরে এসেছিলেন। এখানে জমিদারী তদারকীর কাজে তিনি বিভিন্ন স্থানে পালকিতে চড়ে ভ্রমন করতেন। এজন্য কবিগুরু ভারতের বর্ধমান জেলা থেকে জমিদারী দেখাশুনার কাজে শাহজাদপুরে আসার সময় ৯টি আদিবাসী বাগদি পরিবারকে সাথে নিয়ে আসেন।শাহজাদপুরে এসে কবিগুরু ১৪ শতক জায়গা আদিবাসী ৯টি পরিবারগুলোর বসবাসের জন্য দান করেন।এসময় শাহজাদপুরের বর্তমান আদিবাসী বাগদীদের উত্তরসূরী স্বর্গীয় শশীনাথ বাগদী,অটোল বাগদী,কেদারনাথ বাগদী ও মুরালী বাগদীসহ ওই ৯টি পরিবারের আদিবাসী বাগদীরা করিগুরুকে পালকিতে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন।স্থানীয় আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলো আরও জানায়,কবিগুরুর দানকৃত মাত্র ১৪ শতক জমিতে গন্ধময়,স্যাঁতসেঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ৪৫টি বাগদি পরিবারে প্রায় ২২৫ জন সদস্য মানবেতর অবস্থায় বসবাস করছে। এই বাগদি পরিবারগুলোর বসতির ঘনত্ব এতটাই বেশী যে একটি ঘরের পাশ দিয়ে একজন হেটে চলাই কষ্টকর।চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে চাপাচাপি করে বসবাস করলেও ওই আদিবাসী বাগদীদের মূল পেশা পালকি বাহনের তেমন একটা কাজ না থাকায় অধিকাংশ সময় তাদের বসেই থাকতে হয়।ফলশ্রুতিতে ৪৫টি পরিবারের প্রায় ২২৫ জন সদস্যের মাত্র হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া আবশিষ্ট সবাই শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,রিক্সা চালনা বা স্বল্প আয়ের বিভিন্ন কাজে শ্রম দিয়ে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে।ওইসব ভাগ্যবিড়ম্বিত আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর কোন খোঁজ খবর নেয়না কেউ।কেবল ভোটের সময়ই ওদের মতো অভাগাদের কাছে ভোট প্রাপ্তির আশায় ধর্ণা দেন সমাজপতিরা বলে তারা জানিয়েছেন। এলাকাবাসী জানায়, হরিজন সম্প্রদায়ের আধা যাযাবর এই বাগদী পরিবারগুলোর আদি নিবাস ছিল ভারতের বর্ধমান জেলায়। ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ, চুন তৈরি এবং কুলির কাজ করাই ছিল এদের প্রধান পেশা। ১৮৯০ সালের ২০ জানুয়ারী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে আসেন। এ সময় তাঁর সাথে পরিচিত ঘটে হরিজন সম্প্রদায়ের ওই আদিবাসী বাগদীদের । আদিবাসী বাগদীদের সরলতা আর স্বকীয়তা বোধ কবিকে প্রভাবিত করে। এক সময় এদের ৯টি পরিবারকে কবি তাঁর পালকি বাহকের কাজ দেন। তাদের কাছের ওপর খুশি হয়ে কবিগুরু ৪/৫টি বাগদী পরিবারকে ৩ বিঘা ১৩ শতক জমি বন্দোবস্ত দেন। স্থানীয় আদিবাসী বাগদী পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদেরকে ৩ বিঘা ১৩ শতক জমি বন্দোবস্ত দিলেও বর্তমানে তারা শুধু মাত্র ১৪ শতক জমি ভোগ দখল করছে।অতি স্বল্প পরিসরের ওই জায়গায় অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী আদিবাসী বাগদীদের বসবাসই অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি প্রয়োজনে তাদের ৩ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু দিনে দিনে তাদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বিকল্প স্থানে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বাসস্থানের জমির বন্দোবস্ত করা হয়নি।ফলে মাত্র ১৪ শতক জায়গার ওপর ঠাসাঠাসি করে বর্তমানে বস্তিবাসীর মতো চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তারা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় নানাভাবে উঠে এসেছে শ্রমজীবি এই আদিবাসী বাগদী পরিবারের কথা। কবিগুরু’র বিখ্যাত ছোট গল্প পোষ্টমাষ্টারের রতন চরিত্রটি শাহজাদপুরের বাগদি পরিবারে কোন এক তরুণীকে ঘিরেই আবর্তিত বলে আদিবাসী বাগদি পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে দাবী করা হয়। তবে রতন নামটি হয়তো বা ছিল কাল্পনিক। বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক প্রফেসর নাছিমুদ্দিন মালিথা এ ব্যাপারে জানিয়েছেন,‘যেহেতু আদিবাসী বাগদীরা পালকি বাহন পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিল,সেহেতু ওই আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর কেউ কেউ কবিগুরুর পালকি বহন করে থাকতে পারে।’সাবেক অধ্যক্ষ নূরুল ইসলাম জানান,‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আদিবাসী বাগদী পরিবারগুলোর অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এরাও ইতিহাসের সাক্ষী। যে কারনে শুধু রাষ্ট্র কিংবা সরকারের নয়,আপামর জনতার উচিৎ এই পরিবারগুলোর অমানবিক অবস্থা হতে রক্ষা করা,ওদের পাশে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া। শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, ‘ বিগত সময়ে ২৩ লাখ টাকা ব্যায়ে ২০ জন আদিবাসী বাগদীর প্রত্যেককে ১টি করে গরু প্রদান ও লালন পালনের সকল সুব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও বর্তমানে তাদের মধ্যে টিউবয়েল,ল্যাট্রিনসহ নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। লেখাপড়ায় ব্যাপক ভিত্তিতে উৎসাহ যোগাতে ওইসব হৎদরিদ্র পরিবারগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ইতিপূর্বে ৩ লাখ উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে ’ । ১৪ শতক গন্ধময়,স্যাঁতসেঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর জমিতে ৪৫টি বাগদি পরিবারে প্রায় ২২৫ জন আদিবাসী বাগদীর স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বাসযোগ্য জমি তাদের বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের পূর্নবাসনের কোন ভবিষ্যত পরিকল্পনা উপজেলা প্রশাসনের আছে কি না?-এমন আরেক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও শামীম আহমেদ আরও জানিয়েছেন,‘আদীবাসী বাগদী পরিবারের সদস্যরা যদি গুচ্ছগ্রামে যেতে আগ্রহী হয়, সেক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের গুচ্ছগ্রামে পুর্নবাসনের উদ্যেগ নেওয়া যেতে পারে।’

সম্পর্কিত সংবাদ

বিডিওএসএনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলেন শাহজাদপুরের কৃতি সন্তান  কানিজ ফাতেমা

শাহজাদপুর

বিডিওএসএনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলেন শাহজাদপুরের কৃতি সন্তান কানিজ ফাতেমা

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের এই কৃতি সন্তানকে শাহজাদপুর সংবাদ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার ও ব্যবস্...

কাল থেকে শুরু এইচএসসি পরীক্ষা, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

জাতীয়

কাল থেকে শুরু এইচএসসি পরীক্ষা, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

আগামীকাল রোববার (৬ নভেম্বর) থেকে সারা দেশে একযোগে চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।

শাওয়াল মাসে বিয়ের কোনো ফজিলত আছে কি?

ধর্ম

শাওয়াল মাসে বিয়ের কোনো ফজিলত আছে কি?

সুতরাং শাওয়াল মাসে বিয়ে করাকে যেমন অশুভ মনে করা যাবে না, এ মাসে বিয়ে করাকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মনে করারও কোনো ভিত্তি নেই। ত...

দিনাজপুরে বাঁশের ফুল থেকে চাল, হচ্ছে ভাত-পোলাও

কৃষি

দিনাজপুরে বাঁশের ফুল থেকে চাল, হচ্ছে ভাত-পোলাও

ধান থেকে উৎপাদিত চালের মতো হুবহু এই বাঁশ ফুলের চাল। ভাত, পোলাও, আটা কিংবা পায়েস সব কিছু তৈরি হচ্ছে বাঁশ ফুলের চাল থেকে।...

মোস্তাফিজকে হারাতে হবে বলে মন খারাপ ধোনিদের

খেলাধুলা

মোস্তাফিজকে হারাতে হবে বলে মন খারাপ ধোনিদের

তাই তাঁর পারফরম্যান্সে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে চেন্নাইয়ের ব্যাটিং কোচ মাইক হাসি। আজ আবার মাঠে নামছে চেন্নাই। আজ...

শাহজাদপুরে হোসেন আলী-আলেয়া স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

খেলাধুলা

শাহজাদপুরে হোসেন আলী-আলেয়া স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে পোতাজিয়া ইউনিয়নে আলোকদিয়ার উদয়ন সংঘের আয়োজনে মরহুম আলহাজ্ব হোসেন আলী-আলেয়া স্মৃতির স্বরণে ফুটবল টুর...