শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মায়ের ভাষা ‘বাংলা’র মর্যাদা রক্ষার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে যাঁরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন, তাঁদের প্রথম দশ জনের একজন হলেন শাহজাদপুরের ভাষা সৈনিক আলী আজমল। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক হিসাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ বার তিনি কারাবরণ করেন এবং ১৭ বার পুলিশের মোষ্ট ওয়ান্টেড তালিকায় তাঁর নাম ওঠে। ২০০২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা ৫ দিন অচেতন থাকার পর ৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করলে শাহজাদপুর পৌর এলাকার দরগাহপাড়া কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ভাষা সৈনিক আলী আজমলের স্মৃতি চির অম্লান রাখতে দীর্ঘ সময়েও শাহজাদপুরে তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা ছাড়া কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। আগামীকাল অমর ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উপলক্ষে শাহজাদপুর সরকারি কলেজ কেন্দ্রিয় শহিদ মিনার পরিস্কার পরিচ্ছন্নের কাজ করা হলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ভাষা সৈনিক আলী আজমলের সমাধিস্থল ধুলোবালি ও বুঁনো ঘাসে ভরে উঠেছে। পাশাপাশি তাঁর নামে নামকরণকৃত ভাষা সৈনিক ডা. আলী আজমল বুলবুল সড়কের নামফলক থেকেও পলেস্তারা খসে পড়েছে !

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯২৮ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার পাড়কোলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন আলী আজমল। গ্রামের বাড়ি শাহজাদপুরবাসীর কাছে তিনি ‘বুলবুল ডাক্তার’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা মুহম্মদ সোলায়মান এবং মাতা জোবেদা খাতুন। পিতার চাকুরী সুত্রে আজমলের লেখাপড়া শুরু হয় রাজশাহীতেই। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এই উভয় পরীক্ষাতেই তিনি অভিভক্ত বাংলায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সম্মিলিত মেধা তালিকায় যথাক্রমে ১৩তম এবং ১১ তম স্থান লাভের অসাধারণ গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান লাভ করে কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে তিনি চলে আসেন। তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি নেতৃত্ব দানের অসাধারণ যোগ্যতা ছিল তাঁর। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক হিসাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ১৯৪৮ সালে ছাত্র সমাজ ছিল বিক্ষুদ্ধ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রাভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত প্রথম হরতালে পিকেটিং করতে যেয়ে তিনি আহত হন। আহত অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রিয় কারাগার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তির শর্ত অনুসারে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে জড়িত থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের সাথে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ। ১৪৪ ধারা ভাঙার উদ্দেশ্যে প্রথম দলটির নেতৃত্ব প্রদান করেন আলী আজমল। তিনিই প্রথম গ্রেফতারবরণ করেন এবং ৬ মাস পর মুক্তি পান। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক বদরুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘দশজনের প্রথম ব্যাচ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতা আজমলের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল’, (সূত্র: সংবাদ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০০১)। জহির রায়হান বলেন, ‘প্রথম যাদেরকে পুলিশ ধরেছিল তাদের মধ্যে ছিল ডা. আলী আজমল।’ (তথ্যসূত্র: ভাষা-আন্দোলন কতিপয় দলিল-বদরুদ্দীন উমর, পৃ. ২৩৮)। সেই থেকে ৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১১ বার কারাবরণ করেন এবং ১৭ বার পুলিশের মোষ্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আসামি হিসাবে নাম ওঠে তাঁর। এসব কারণে কর্তৃপক্ষ তাঁকে মেডিকেল কলেজ থেকে বহিস্কার করেন। ফলে তাঁর আর এমবিবিএস পাশ করা হয়নি। ১৯৫৪ সালে আলী আজমল নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে এসে তিনি শাহজাদপুর পৌর এলাকার মণিরামপুর বাজারস্থ পিতার ক্রয়কৃত বাড়িতে সর্বসাধারনের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হন। আমৃত্যু তিনি অত্যন্ত সাধারন একটি টিনের বাড়িতে নামমাত্র ফি গ্রহণ করে হতদরিদ্রের চিকিৎসাসেবায় নিরত থাকেন। সর্বসাধারণের কাছে তিনি ‘বুলবুল ডাক্তার’ নামেই পরিচিত ছিলেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর যে অসাধারণ সাফল্য এবং সুনাম-সুখ্যাতি ছিল তাতে তিনি রীতিমত অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু চিকিৎসাকে তিনি মানুষের সেবা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসাবে নয়। তিনি খুব সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। ১৯৫২ সালে ক্ষতিগ্রস্থ অনেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এমবিবিএস ডিগ্রি গ্রহণ করেন। কিন্তু আজমল তাঁর চারপাশের মানুষ এবং রোগীদের ছেড়ে আর কখনও ডিগ্রি লাভের পেছনে ছোটেন নি। আজমল সব ধরনের বই এবং পত্রিকার নিষ্ঠাবান পাঠক ছিলেন। তিনি যা কিছু পড়তেন, তার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। বাংলা, ইংরেজি, অংক, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল বিষ্ময়কর। জনাব আজমলের কাছে দেশ ও দেশের মানুষ ছিল নিজের চেয়ে বড়। তাইতো ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু তিনি দেশের মানুষের অধিকার ও দাবী আদায়ে ছিলেন সোচ্চার। নিজের আরাম-আয়াশ ও স্বার্থ ত্যাগ করে সমাজের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন তিনি। এভাবেই একদিন আজমল জীবন সায়াহ্নে চলে আসেন। তাঁর জীবনের সমস্ত কাজ কর্মের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী খুরশিদা আজমল পুতুল। সেই স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি অনেকটা চুপচাপ হয়ে যান। ক্রমশ বেশ অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। শ্বাস কষ্টের সাথে অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয় তার শরীরে। ২০০২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা ৫ দিন অচেতন থাকার পর ৩ অক্টোবর পরলোক গমন করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর শাহজাদপুরবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে শাহজাদপুর পৌর এলাকার দরগাহপাড়াস্থ হযরত মখদুম শাহদৌলা শহিদ ইয়ামেনি (রহ.)’র মসজিদ ও মাজার সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে আলী আজমল ছিলেন সবার বড়। মেঝ ভাই আহম্মদ আলী আজমল এম.কম বিসিআইসি’র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ছোট ভাই ব্যবসায়ী আক্তার আলী আজমল বিএ পৈত্রিক বাড়িতেই আছেন। জীবিত তিন বোনের মধ্যে ছোট দুই বোন মাধ্যমিক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষিকা। আজমলের একমাত্র ছেলে এডভোকেট কবির আজমল বিপুল বি.এ (অনার্স) এমএ (ইংরেজি) এবং পুত্রবধূ নাছিমা জামান কলেজের অধ্যাপিকা। বড় মেয়ে ঢাকা শাহীন কলেজের শিক্ষক রওনক আজমল বন্যা বি.এ (অনার্স) এম.এ। তাঁর স্বামী আবু করিম সাবেক সচিব এবং দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। মেঝ মেয়ে ডা. ফেরদৌসী আজমল মেঘনা এবং তার স্বামী ডা. আব্দুর রহমান স্বাস্থ্য বিভাগের পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।

সূধীজনের মতে, ‘ভাষা সৈনিক আলী আজমলের সমাধিস্থল যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণসহ তাঁর স্মৃতি চির অম্লান রাখতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।’

সম্পর্কিত সংবাদ

উল্লাপাড়ায় ষাঁড়ের শিংয়ের আঘাতে গৃহবধুর মৃত্যু

অপরাধ

উল্লাপাড়ায় ষাঁড়ের শিংয়ের আঘাতে গৃহবধুর মৃত্যু

তানিম তূর্যঃ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ষাঁড়ের শিংয়ের আঘাতে খুশি বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধুরর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বিক...

শাহজাদপুরে পৌরসভা ও অগ্নিবীণা সংসদে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

দিনের বিশেষ নিউজ

শাহজাদপুরে পৌরসভা ও অগ্নিবীণা সংসদে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : আজ শুক্রবার শাহজাদপুর পৌরসভা ও ঐতিহ্যবাহী অরাজনৈতিক সংগঠন অগ্নিবীণা সংসদের উদ্যোগে ইফত...

উল্লাপাড়ায় নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার

উল্লাপাড়া

উল্লাপাড়ায় নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার

তানিম তূর্যঃ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর পুকুর থেকে ইয়াম ইসলাম( ৮) নামের এক শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে...

উপজেলা কাপড়ের হাট আড়ৎ মালিক সমিতির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

অর্থ-বাণিজ্য

উপজেলা কাপড়ের হাট আড়ৎ মালিক সমিতির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

শাহজাদপুর উপজেলা সংবাদদাতাঃ শাহজাদপুর উপজেলার কাপড়ের হাট আড়ৎ মালিক সমিতির নব-নির্বাচিত ক...

নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা কথা

উপ-সম্পাদকীয়

নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা কথা

জামায়াত নেতা নিজামীর রায় বুধবার