শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫

 দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিলের নাম শুনলেই দেহমনে জাগে অন্যরকম শিহরণ। ষড় ঋতুর দেশে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের লীলাভূমি ও মৎসম্পদে ভরপুর এ চলনবিলকে সাজতে দেখা যায় একেক ঋতুতে একেক রূপে। বর্ষাকালে বিলটি যৌবন ফিরে পায়। এসময় সাগরের মতো বিশাল জলরাশিতে ভরপুর চলনবিল নিজের ঐহিহ্যের জানান দেয়। শরৎকালে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের করুকাজ দেখা যায়। হেমন্তকালে আবার বিলটি আপন নৈপুন্যে মাথা নোয়ানো সোনালি ধানের শৈল্পিক বাহার আর সোঁদা মাটির গন্ধে পাগল করে তোলে চারদিক। শীতকালে ছোঁয়া কাঁচা হলুদ রংয়ের থইথই উচ্ছ¡াস আর দিগন্তজোড়া সবুজের থরথর কম্পন। আবার, গ্রীস্মকালে চলনবিল আপন পৌরুষে দেখা দেয় তেজী ও রুক্ষ রূপে । কয়েক বছর আগেও চলনবিলের ছয়আনিবিল, বাঁইড়ারবিল, সাধুগাড়ীবিল, সাঁতৈলবিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ারবিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরারবিল, নিহলগাড়ীবিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়িবিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়িবিল, খৈগাড়িবিল, বৃহরিলাবিল, দিগদাড়িয়াবিল, খুলুগাড়িবিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ারবিল, ধলারবিল, ধরইলবিল, বড়বিলা, বালোয়াবিল, আমদাকুরীবিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরীবিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়াবিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণেরবিল, নলুয়াকান্দিবিল, ঘরগ্রামবিল, বেরলবিল, কচিয়ারবিল, কাশিয়ারবিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, চিরলবিল, ডিকশীবিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়াবিল, আইড়মারীবিল, কৈখোলাবিল, কানচগাড়ীবিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গাবিল, মেরীগাছাবিল, খলিশাগাড়ীর বিলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো দেশীয় প্রজাতির নানা মাছসহ শাপলা ও পদ্ম ফুল। কিন্তু, বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য সময়ে চলনবিলের আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপী (মরা আত্রাই), নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, বিলসূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা, বেহুলার খাড়িসহ নানা বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যায়। ফলে চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ, নানা প্রজাতির শাপলা, পদ্ম, গুল্মলতা ও জলজ প্রাণি । সাদা বর্ণের শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ। বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বিল বাওড় জমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। যথাযথ উদ্যোগ আর সংরক্ষণের অভাবে দেশের বৃহত্তম চলনবিল কালক্রমে তার নিজস্ব রূপ, সম্পদ, ঐতিহ্য সব কিছুই হারাতে বসেছে!

জানা গেছে, দখল-দূষণের কবলে পড়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে দেশের বৃহত্তম চলনবিলের নদ-নদী। বহুবিধ কারণে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বিলের অধিকাংশ খাল। ভূ-উপরিস্থ পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে নীচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও। ফলে কালের আবর্তে সময়ের পরিধিতে নিরবে নিভৃতে বিলুপ্ত হতে বসেছে চলনবিলের জীববৈচিত্র। সেইসাথে বিরাট এই অঞ্চলের কৃষকের বুকে টনটনে ব্যাথা জাগিয়ে ব্যাহত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কৃষি আবাদ। এছাড়াও, নানা কারণে মৎস ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিল দিনদিন হারিয়ে ফেলছে তার চিরচেনা রূপ আর গৌরবময় ঐতিহ্য। চলনবিলে আশীর্বাদের মত অতীতে ফুঁটতো ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ নানা প্রজাতির শাপলা, পদ্ম ফুল ও গুল্মলতা। চোখ জুড়ানো নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল ও বেগুণী শাপলা ফুল মাথা উঁচু করে টেনে ধরতো কোমল হৃদয়। বর্ষাকাল ছাড়া সেই বিলে আর দেখা যায়না পদ্ম ও শাপলা। দেখা মেলে কচুরি ও কলমি ফুল। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নিতো পদ্ম ও শাপলা। গ্রাম বাংলার আবহমান কাল থেকেই শাপলা ও এর মূলে হৃদপিন্ডের মত বেড়ে ওঠা শালুক মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত ছিল। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত পদ্ম মধু, শালুক, ঢ্যাপের খই ও খইয়ের মোয়া যা বর্তমানে হয়েছে অতীত। এক সময় চলনবিলাঞ্চলের স্বল্প আয়ের অভাবী মানুষেরা বিল থেকে পদ্ম মধু, শাপলা-শালুক ও মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এসব। ফলে ওইসব অভাবী মানুষের অনেকেই বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে আবার অনেকেই পেশা বদলেছে।

 ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বগুড়া জেলার শেরপুর ও নন্দীগ্রাম এবং নওগা জেলার আত্রাই ও রাণীনগর নিয়ে চলনবিলের অবস্থান ছিল। 

১৯৬৭ সালে এমএ হামিদ ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে।’ 

১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির ¯্রােতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গঠনকালে চলনবিলে মোট এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৩১ দশমিক ০ কিলোমিটার। এছাড়া বিলের গভীরতা এক দশমিক ৫৩ মিটার থেকে এক দশমিক ৮৩ মিটার; সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ১৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার। 

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলা লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, আঁশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলো গ্রাম, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.৫২ মিলি গ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাইমেটার ৮.৪, ক্রড আমিষ ১৬.৮, ক্রড ফ্যাট ২.৮, ক্রড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ।’ অতীতকাল থেকেই শাপলার ফল দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খই ভাজা হতো। যেটি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে ঢ্যাঁপের খই নামে পরিচিত। শাপলার মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি কমে যায় তখন অভাবী মানুষ শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করতো। সিদ্ধ শালুক বেশ সুস্বাদু। শাপলা চুলকানি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। ডায়াবেটিক, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনারি সমস্যা ও নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে লাল শাপলা খুবই উপকারী।’

বিজ্ঞ কৃষিবিদগণের মতে, শাপলা সাদা বেগুণী ও লাল রঙের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ঔষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবজি । সাধারন শাক-সবজির চেয়ে শাপলার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমান আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। খাল বিল জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলা জন্মানো ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে দেশে বাণিজ্যিকভাবে শাপলার চাষ হয় না বলেও জানিয়েছেন কৃষিবিদরা।

বিজ্ঞমহলে মতে, জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল আবাদে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ দখল ও প্রয়োজনীয় পানি না থাকাসহ বহুবিধ কারণে চলনবিল থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে শাপলা ও পদ্ম ফুল। এখন খাল-বিল-জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা। আগে অনেকে সৌন্দর্যের জন্য পুকুরে চাষ করতেন লাল শাপলা । এ বিলে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছসহ বিদেশি কার্প জাতীয় মাছ চাষ হওয়ায় বেগুণী ও লাল শাপলা বিলুপ্তির পথে। আগে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত ঢ্যাপের খই ও মোয়া। এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না পদ্ম মধু ও সুস্বাদু ঢ্যাপের খইয়ের মোয়া। তাছাড়া, শীত মৌসুমে অতিথি পাখির পদচারণায় চলনবিল মুখরিত ও পাখিদের অভয়ারণ্য পরিলক্ষিত হলেও নানা কারণে আগের মতো আর অতিথি পাখির দেখা মেলে না। সব মিলিয়ে চলনবিল হারাতে বসেছে তার প্রাচীণ ঐতিহ্য। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্টদের এখনই নানাবিধ কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থাগ্রহণ অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। 

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে সরকারি গাছ বিক্রি করে ঋণের দায় শোধ স্কুল দপ্তরির!

অপরাধ

শাহজাদপুরে সরকারি গাছ বিক্রি করে ঋণের দায় শোধ স্কুল দপ্তরির!

শাহজাদপুরে ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে পাওয়ানাদারকে সরকারি ক্যানেলের ৫০টি সরকারি গাছ বিক্রি করে টাকা নিতে বলেছেন

রবীন্দ্র অনুরাগী ভক্তের মিলনকেন্দ্র কবিগুরুর কাছারিবাড়ি

দিনের বিশেষ নিউজ

রবীন্দ্র অনুরাগী ভক্তের মিলনকেন্দ্র কবিগুরুর কাছারিবাড়ি

সিরাজগঞ্জ জেলার দুগ্ধশিল্প ও তাঁতসমৃদ্ধ শাহজাদপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্র দ্বারিয়াপুরে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ

আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫ তম জন্মবার্ষিকী

জাতীয়

আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫ তম জন্মবার্ষিকী

অসহায় বন্যাদুর্গতদের মাঝে সার্কেল শাহজাদপুরের উদ্দ্যোগে ত্রান বিতরন

বন্যা

অসহায় বন্যাদুর্গতদের মাঝে সার্কেল শাহজাদপুরের উদ্দ্যোগে ত্রান বিতরন

বৃহস্পতিবার সকালে শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা নদী তীরবর্তী সোনাতুনী ইউনিয়নের প্রত্যান্ত অঞ্চল ও ভয়াবহ বন্যা কবলিত দুর্গম চরা...

ঈদ ফ্যাশানে শাহজাদপুরের তাঁতের শাড়ী দেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে!