বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রজেক্ট এর আওতায় উপজেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় খাদ্যে ভেজাল, জনস্বাস্থ্য, নৈতিকতা, আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি বিষয়ক সমাবেশ ও কর্মশালায় উপস্থাপিত প্রবন্ধ।

স্থানঃ- শাহজাদপুর উপজেলা শহিদ স্মৃতি সম্মেলন কক্ষ,সিরাজগঞ্জ। (তারিখ- ১৮’ জানুয়ারী’ ২০১৫ ইং)।

ফরমালিন পরিচিতিঃ

সুপ্রিয় পাঠক, আপনাদের অবগতির জন্য ফরমালিনের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উপস্থাপন করতে চাই। ফরমালিন বর্ণহীন তীব্র ঝাঁজালো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। ফরমালডিহাইড পানিতে সহজে দ্রবণীয়। পানিতে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইড এবং ০.১৫ শতাংশ মিথানলের দ্রবণকে ফরমালিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ফরমালডিহাইড শরীরে পুঞ্জীভূত হয় না। ফরমালডিহাইড হল একটি মধ্যবর্তীকালীন রূপান্তরিত রাসায়নিক পদার্থ এবং প্রতিটি কোষেই ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়। ফরমালডিহাইড অত্যন্ত ক্রিয়াশীল এবং প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের সঙ্গে বন্ধনে মিলিত হয়। রক্তে ফরমালডিহাইডের হাফলাইফ (যে সময়ের মধ্যে কোনো রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বা মাত্রা অর্ধেকে নেমে আসে) মাত্র ৯০ সেকেন্ড। ফরমালডিহাইড অক্সিডাইজড (রাসায়নিক রূপান্তর) হয়ে অতিদ্রুত ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়, যা প্রস্রাবের মাধ্যমে এবং কিছু অংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়ে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাছাড়াও ফরমালডিহাইড শরীরে প্রোাটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড সংশ্লেষণের আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফরমালিন আমাদের দেহে প্রবেশের সুযোগ পায়। ১৮৫৯ সালে আলেকজান্দর বুতলারভ ফরমালিনের অস্তিত্ব তুলে ধরেন এবং ১৮৬৯ সালে উইলহেম ভন হফমেন তা চূান্তভাবে চিহ্নিত করেন। রাসায়নিকভাবে কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের সংমিশ্রণে ফরমালিন তৈরি করা হয়। এর ব্যবহার ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট। পৃথিবীর জনজীবনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফরমালিনের এই চরম ক্ষতিকর ব্যবহার হবে তা আঁচ করতে পারলে রুশ রসায়নবিদ আলেকজান্দর বুতলারভ ও জার্মান রসায়নবিদ উইলহেম ভন হফমেন হয়তো লজ্জিত হতেন! ফরমালিনের বৈশিষ্টঃ - ফরমালিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংক্রমিত হতে না দেয়া। অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাককে মেরে ফেলতে পারে। ল্যাবরেটরি, রং তৈরি, বস্ত্র খাতে কাপড় কুঞ্চিত হতে না দেয়া, সংরক্ষণ, বিস্ফোরণ এবং পলিমার তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। ফরমালিন এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ। বর্ণহীন ও দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস হিসেবে এর সবিশেষ পরিচিতি রয়েছে। এটি আগুনে জ্বলে এবং বিষাক্ত পদার্থবিশেষ। বিভিন্ন খাদ্যে ফরমালিনের পরিমানঃ - পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন খাদ্যে ফরমালিন থাকে। মাছ, মাংস, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবেই ফরমালডিহাইড উপস্থিত থাকে। প্রতি কিলোগ্রাম আপেলে ৬.৩ থেকে ২২.৩ মিগ্রা, কলায় ১৬.৩ মিগ্রা, বিটে ৩৫ মিগ্রা, ফুলকপিতে ২৭ মিগ্রা, গরুর মাংসে ৪.৬ মিগ্রা পালং শাক প্রতিকেজিতে ৩৫ মিলিগ্রাম, বিভিন্ন সবজি প্রতিকেজিতে ১১ মিলিগ্রাম, বাঁধাকপি গ্রতিকেজি ৫ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম, গাজর গ্রতিকেজিতে ৬ দশমিক ৭ থেকে ১০ মিলিগ্রাম, শসা প্রতিকেজিতে দুই দশমিক ৩ থেকে তিন দশমিক ৭ মিলিগ্রাম, আঙ্গুরে ২২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম, পেঁয়াজ প্রতিকেজিতে ১৩ দশমিক ৩ থেকে ২৬ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম, ওলকফি প্রতিকেজিতে ৩১ মিলিগ্রাম, নাশপাতি প্রতিকেজিতে ৩৮ দশমিক ৭ থেকে ৬০ মিলিগ্রাম, আলু বোখারা প্রতিকেজিতে ১১ দশমিক ২ মিলিগ্রাম, আলুতে প্রতিকেজি ১৯ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম, লতাপাতা প্রতিকেজিতে তিন দশমিক ৩ থেকে ৭ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম, টমেটো প্রতিকেজিতে ৫ দশমিক সাত থেকে ১৩ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম, তরমুজ প্রতিকেজিতে ৯ দশমিক ২ মিলিগ্রাম, মুলা প্রতিকেজিতে ৩ দশমিক ৭ থেকে ৪ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম, শুকনা মারিচ প্রতিকেজিতে ১০০ থেকে ৪০৬ মিলিগ্রাম ফরমাল ডিহাইড থাকে। এছাড়া ছাগলের দুধ প্রতিকেজিতে ১ মিলিগ্রাম, গরুর দুধে ৩ দশমিক ৩ মিলিগ্রামের নিচে এবং একই মাত্রা থাকে পনিরেও। এছাড়া মাছ প্রতিকেজিতে ৬ দশমিক ৮, চিংড়ি প্রতিকেজিতে ১ থেকে ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম ফরমালডিহাইড থাকে। এভাবে প্রত্যেকটি খাদ্যেই প্রাকৃতিকভাবে কিছু ফরমালডিহাইড রয়েছে। সঙ্গত কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন দেশে ফরমালিন পরীক্ষার মেশিনে প্রাকৃতিক ফরমালিনের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও তাদের পণ্য বিনষ্ট করা হচ্ছে। এ ছারাও প্রতিদিন আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে কম-বেশি ফরমালডিহাইড শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করি। কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও বাস্পের মধ্যেও ফরমালিন থাকে, যা প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে ঢুকছে। সিগারেটের ধোঁয়া, এমনকি বৃষ্টির পানিতেও ফরমালডিহাইড থাকে। ফরমালডিহাইড শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি প্রাকৃতিক উপাদান। তবে মাত্রাতিরিক্ত ফরমালডিহাইড বিষাক্ত। ফরমালিনের কারণে কার কতটুকু ক্ষতি হবে, তা নির্ভর করে ফরমালিনের মাত্রার ওপর। মাত্রারিক্ত ফরমালিন ব্যবহারে বিপত্তিঃ - তবে মাত্রারিক্ত ফরমালিন দিয়ে খাদ্য সংরক্ষণ করতে গেলে নানা বিপত্তি ঘটে । মানুষের শরীর দুই পিপিএম মাত্রার ফরমালিন সহ্য করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন সর্বোচ্চ ১২৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন দিয়ে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বিগত ২০১১ সালের ১০ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম থেকে বলা হয়, ফরমালিন মানুষের ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি সম্পৃক্ত। এর আগেই অবশ্য বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ফরমালিন ব্যবহার ও ফরমালিনজাত দ্রব্য আমদানিতে বিধি-নিষেধ আরোপ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফরমালিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে দেখা গেছে- গলাধঃকরণ করা হলে ফরমালিন বিষাক্ত হতে পারে। আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বা আকস্মিক ভুল-ভ্রন্তির কারণে ফরমালডিহাইড ব্যবহারে মুখ, গলা, অন্ত্র জ্বলে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। ফরমালডিহাইড শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যকৃতে (লিভার) ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়ে মেটাবলিক অ্যাসিডোসিস (রক্তের অম্লত্ব¡ বৃদ্ধি) উৎপন্ন করে। ফরমিক অ্যাসিড শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটানো ছাড়াও যকৃত ও কিডনি ধ্বংস করতে পারে। পরিস্থিতি তীব্র হলে শরীরে খিচুনি ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রেও বিষাদগ্রস্ততার (ডিপ্রেশন) কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ৩১৭-৪৭৫ মিলিগ্রাম ফরমালিন ৭০ কিলো ওজনের একজন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। ফরমালিনে মিথালনের উপস্থিতি মানুষের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়। ফরমালিনের ছিটা চোখে পড়লে অস্বস্তি ছাড়াও চোখের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে পারে। ফরমালডিহাইড মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর উপসংহারে এসেছে যে, বারবার ও দীর্ঘ সময়ের জন্য ফরমালডিহাইডের সংস্পর্শে মানবদেহের নাক, ফুসফুস, গলায় ক্যান্সার উৎপন্ন করে। ফরমালডিহাইড নিজে ক্যান্সার উৎপন্ন করে অথবা এ মরণঘাতী রোগ সৃষ্টিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর ও কুকুরের মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, ফরমালিনের কারণে পাইলোরাসে অ্যাডেনোকারসিনোমার মতো অন্ত্রের ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। অন্যান্য পরীক্ষাও দেখা গেছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফরমালিন গ্রহণের কারণে গার্মেন্ট শ্রমিকদের গলা, সাইনাস, নাকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। প্রতি লিটারে ০.৫-২.০ মিগ্রা ফরমালিন চোখ, নাক, গলার সংস্পর্শে এসে জ্বালা-যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। প্রতি লিটারে ৩-৫ মিগ্রা ফরমালিন চোখে পানি আনতে পারে। ১০-২০ মিগ্রা ফরমালিনের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট বাড়ে। ২৫-৩০ মিগ্রা ফরমালিন শ্বাসনালীতে মারাতœক ক্ষত সৃষ্টি করে। ১০০ মিগ্রা ফরমালিন স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফরমালডিহাইড শরীরে প্রবেশ করাটা যেমন বিপজ্জনক, গলাধঃকরণ তেমনি বিপজ্জনক। চামড়ার সংস্পর্শে ফরমালিন এলে চামড়া পুড়ে যেতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের এলার্জির উপদ্রব দেখা দিতে পারে। বেশিমাত্রায় ফরমালিন শরীরে ঢুকলে কোষের প্রতিটি উপকরণের সঙ্গেই তা বিক্রিয়া করার ক্ষমতা রাখে এবং এর ফলে কোষ তথা প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে বিঘœ ঘটায়। ফরমালিনে মিথানলের উপস্থিতি ফরমালডিহাইডের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। কারণ মিথানলও লিভারে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়, যা রক্তের অম্লত্বের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রক্তে অম্লত্ব বৃদ্ধি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের মারাত্মক অবনতি ঘটাতে পারে। ফরমালডিহাইড দ্র্রবণে থাকলে তা ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। ফরমিক অ্যাসিড ক্ষত সৃষ্টিকারী বস্তুু। সুতরাং ফরমালডিহাইড ও ফরমিক অ্যাসিড মাত্রাভেদে শরীর-চামড়ার সংস্পর্শে এলে জ্বালা-পোড়া ছাড়াও স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রেখে যেতে পারে। ক্ষয়িষ্ণু বলে ফরমালিন চোখেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ফরমালিনের মতো ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ চোখের দৃষ্টিশক্তির অবনতি ঘটানো ছাড়াও দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারে। আমাদের দেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে বিষ মিশিয়ে লাভবান হলেও প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে ক্রেতা বা ভোক্তারা। তাদের মতে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে মানুষ দীর্ঘমেয়াদী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বদহজম, পেটেরপীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়ার মতো জটিল রোগের শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রাসায়নিক পদার্র্থের কারণে মহিলারা যেমন বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিতে পারে। শিশুরাও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া রাসায়নিক মেশানোর ফলে পুষ্টি ও স্বাদ উভয়ই নষ্ট হয়ে যায়। ফরমালিন থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। ফরমালিনের ব্যবহার আমাদের জন্য এক মহাবিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে ফরমালিনের ব্যাবহারে আইনী প্রয়োগঃ- ফরমালিন ব্যবহার শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের আশপাশের অনেক দেশেই ফরমালিন ব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য ও ওষুধ সংস্থা, যাকে সংক্ষেপে বিপিওএম বলা হয়, এক সমীক্ষায় দেখতে পায়, একশ্রেণীর অসাধু ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্য, বিশেষ করে মাছ, টফু ও আর্দ্র নুডুলস সংরক্ষণে ব্যাপকভাবে ফরমালিন ব্যবহার করে আসছে। আমাদের দেশে খাদ্যসামগ্রীতে ফরমালিন অপব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে বটে; কিন্তু এর কার্যকর হয় খুবই কম। যদিও হয়ে থাকে তা কয়েক বছর পর। বিচারব্যবস্থার এই এতিম অবস্থা আমাদের ভোগাচ্ছে অতীত থেকে। সবার মুখে একই কথা, আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। সিঙ্গাপুরে আইনি ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগের কথা জানাযায়। সেখানে মাদক ও ভেজালের শাস্তি ৮ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই কার্যকর হয়। মাদকসামগ্রী রাখা ও পণ্যে ভেজাল দেয়ার কোনো তথ্য পেলে শনাক্তকারী ব্যক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা আজীবন কারাদন্ড। ওই দেশে বসবাসকারী বাঙালি বন্ধুর কাছে এ কথা শুনেছি। যৌন হয়রানি করেছে এমন নারী-পুরুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তিন বেত্রাঘাত, এতে ওই দুর্বৃত্ত ব্যক্তির পুরষত্ব¡ বা নারীত্ব নিঃশেষ হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ওই সভ্য দেশটিতে রাজনৈতিক বিবেচনা বা নির্বাহী প্রধানের আতœীয় পরিচয়েও রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের প্রিয় পুত্র বা কন্যাও যদি এ ধরনের অপকর্র্মের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন প্রমাণ মিললে তার শাস্তিও একই বিধানে একই পদ্ধতিতে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর হয়ে থাকে। আইনের দুর্বলতম দিকগুলোর সংস্কার না হওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, প্রতিদিন ৫০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, খুনের ঘটনা ঘটছে ৮ থেকে ১০টি। আইনের দুর্বলতার কারণে কিংবা ঘুষ ও রাজনৈতিক বিবেচনা বা আতœীয় ও দলীয় পরিচয়ে সুবিচার বিঘিœত হচ্ছে। আমরা হতদরিদ্র গোটা জাতি ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর পথযাত্রী হচ্ছি। এই ভেজাল খাদ্যের কারণে দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ অনারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পথে। ক্যান্সারের জীবাণু এ ৬৫ শতাংশ মানুষের শরীরে সুপ্ত অবস্থায় আছে। টিউমারটি ফেটে গেলেই তা ঘাতক আকারে সারা শরীরকে আক্রমণ করে জীবন্ত মানুষটিকে এক সময় মেরে ফেলবে। বিস্ময়কর যে, সরকার এখনো বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবছে না। বিশেষ করে শাস্তির ব্যাপারে কঠোর হতে পারছে না। ফরমালিন আমদানি ঃ - ফরমালিন এমন একটি পণ্য যেটা বাংলাদেশে উৎপন্ন হয় না। পণ্যটি বিদেশ থেকে আসে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। ল্যাবরেটরির কাজে ও মানুষের মৃত্যুর পর পচনরোধে এই ফরমালিন জাতীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজন যেখানে ১০০ টন, সেখানে আসছে ৫০০ থেকে ১০০০ টন। এগুলো কোথায় ব্যবহার হয়, নিশ্চয়ই প্রশাসন ভালো করেই জানে। জেনেও না জানার ভান করে। বছরে ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে,মৃত্যু থেমে নেই ঃ বিশ্বখাদ্য এবং কৃষি সংস্থার তথ্যমতে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এক সেমিনারে বলা হয়েছে, ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতিবছর তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, ৫০ হাজার লোক ডায়াবেটিসে এ আক্রান্ত হয়। দুই লাখ লোক কিডনি জটিলতায় ভোগেন। প্রতিদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ডায়রিয়া রোগের প্রধান কারণ অনিরাপদ খাদ্য এবং পানি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ২০২০ সালের মধ্যে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে। আশঙ্কার কথা হচ্ছে দেশে খাদ্যের ভেজাল নিয়ে সে রকম কোন গবেষণা হয়নি। পরীক্ষা করে খাদ্যে ভেজাল নির্ণয় করা হলেও কোন খাদ্যে আমাদের কতটুকু ক্ষতি হতে পারে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি তা নিয়ে কোন গবেষণা এখনও পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু খাদ্যে বিষক্রিয়া আর হেবি মেটাল মানুষের শরীরে কি কি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে বিভিন্ন সময় সচেতন করছেন খাদ্য এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা। উত্তরের জেলা দিনাজপুরে ২০১২ সালের জুনে বিষাক্ত লিচু খেয়ে মারা গল ১৪ শিশু। মূলত কীটনাশকের বিষক্রিয়ার শিকার হয় ওই সব শিশু। এর আগে ২০০৯ সালে রিড ফার্মার প্যারাসিটামল সিরাপ কেড়ে নেয় ২৪ শিশুর প্রাণ। একই বছর ধামরাইতে কীটনাশক মেশানো সবজি খেয়ে কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। এর ঠিক আগের বছর ২০০৮-এ নওগাঁয় একই কারণে আরও কয়েকজনের প্রাণ যায়। কীটনাশক আর রিডফার্মার প্যারাসিটামল সিরাপের ডাই ইথানল গ্লাইকল তাৎক্ষণিক প্রাণঘাতী হলেও সেøা পয়জন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে প্রতিদিনের খাদ্যকে। কিন্তু উৎপাদন থেকে সরবরাহ কোন জায়গাতে বিষাক্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত ঃ - জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে সম্প্রতি দেশি-বিদেশি একদল গবেষক ৮২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশান এলাকাসহ আরো বেশ কিছু বড় বড় বাজার থেকে এসব খাদ্যের নমুনা (স্যাম্পল) সংগ্রহ করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়। ওই গবেষণার ফলাফল অনুসারে ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। এ ছাড়া আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব¡। এ ছাড়া চারটি প্যাকেটজাত জুসের নমুনায় পাওয়া গেছে বেঞ্জয়িক এসিড, যা স্বাস্ব্যহানিকর। 'ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ' প্রকল্পের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেছেন, 'সারা দেশের পরিস্থিতি এখনো আমরা দেখতে পারিনি। তবে ঢাকায় আমরা গবেষণার মাধ্যমে যে ভয়াবহ চিত্র পেয়েছি তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছি। এখন এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করার দায়িত্ব সরকারের।' গবেষক দলের সূত্র জানায়, যখন এ গবেষণা হয়, তখন বাজারে দেশীয় মৌসুমি ফল ছিল না। তাই ওই সময় প্রাাপ্ত ফলের মধ্যে আপেল ও আঙ্গুরে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে। তবে তখনো বাজারে থাকা কিছু আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গিয়েছিল। ব্রয়লার মুরগি ও চাষ করা মাছের মধ্যে রুই-কাতল জাতীয় মাছে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ফরমালিন ছিল বিভিন্ন মাছে। শুঁটকিতেও মিলেছে বিষাক্ত রাসায়নিক। এ ছাড়া হলুদ ও লবনে সীসাসহ আরো কিছু ধাতব উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো চকচকে ও ভারী করা হয়। থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া অর্ধেক রোগী বাংলাদেশী, এদের বেশিরভাগ লিভার, কিডনি ও প্রজনন সমস্যায় ভোগেন। এসব সমস্যার উদ্ভব হয় খাদ্যের ভেজাল ও বিষ থেকে। টিআইবি গত মার্চে প্রকাশিত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, সুশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গবেষণায় এ কথা বলছে। রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ড. মাহামুদুর রহমান বলেছন, শরীরের সব অর্গানেই ভেজাল ও ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্যের প্রভাব পড়ে। এসব খাদ্য নীরব ঘাতক। কিন্তু খাদ্যে কি পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ থাকলে আমাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে সে বিষয়ে এখনও কোন গবেষণা হয়নি। তিনি বলেন, খাদ্যে সীসা, আর্সেনিক, অ্যালড্রিন, ডিডিটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ফরমালিনকে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছেন কিন্তু ফরমালিন খাদ্যের প্রিজারভেটিভই নয়। এ কারণে সামান্য পরিমাণ ফরমালিনও খাদ্যে ব্যবহার করা কোন অবস্থাতে উচিত নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আগে ভেজাল খাদ্যের ফলে মানুষের কিডনি এবং লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এমনটি বলা হতো। এখন মানুষের হৃদরোগে আক্রান্তের জন্যও ভেজাল খাদ্যকে দায়ী করা হচ্ছে। গবেষণায় হৃদরোগে আক্রান্তদের রক্তে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিষক্রিয়ার অস্তিত্ব মিলেছে। দেশের সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে রোগীর মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের অন্যতম হার্ট এ্যাটাক। জেলা হাসপাতালে এ অবস্থান দ্বিতীয় এবং উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চতুর্থ। আর সরকারের একমাত্র বিশেষায়িত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে হৃদরোগের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি রোগীদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগীই আসে হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে। দেশীয় গবেষণায়ও হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্তদের রক্তে ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ফলে খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। গবেষণায় দেখা গেছে অসংক্রামক রোগের কারণে বিশ্বে বছরে তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। ভেজাল খাদ্য দক্ষিণ এশিয়ায় অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ৭৯ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ এতকিছুর পরও নিরাপদ খাদ্যর মান নিয়ন্ত্রণে দেশে পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেই। খাদ্য পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য কাজের চাপ অনুযায়ী পরীক্ষাগারে রয়েছে জনবল সঙ্কট। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পিএইচএলের পরীক্ষাগারে সর্বমোট অনুমোদিত পদ হচ্ছে ৩৪টি। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৫৩ সালে পরীক্ষাগার স্থাপনের সময় থেকে একই জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। এর মধ্যে পরীক্ষাগারের মৌলিক পদ হচ্ছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে একজন পাবলিক এ্যানালিস্ট, দুইজন প্রধান সহকারী এবং ছয়জন ল্যাব সহকারী। এ পরীক্ষাগারে প্রতিমাসে দেশের স্যানেটারি ইন্সপেক্টররা ৭০০ থেকে ৮০০ নমুনা পাঠায় কিন্তু জনবল সঙ্কটে এর অর্ধেকও পরীক্ষা করা হয় না। শুধু এ পরীক্ষাগারই নয় দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোতেও রয়েছে পৃথক পরীক্ষাগার তবে এসব পরীক্ষাগারে বাজার থেকে ভেজাল পণ্য ধরা হলেও পরীক্ষার পর অদৃশ্যকারণে পণ্যের মান যথাযথ দেখিয়ে সার্টিফিকেট দেয়া হয়। নিরাপদ খাদ্যের তদারকি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বিএসটিআই কাজের পরিধি ও ভৌগোলিক আওতা বিবেচনায় মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের কাজের এলাকা দেশের ৬৪ জেলা ও ৪৮৭ উপজেলা বিস্তৃত। নিরাপদ খাদ্যের তদারকি কার্যক্রমে বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সারাদেশে ৫৬৬ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর রয়েছে। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সব পদ পূরণ থাকলেও তাদের কাজের ক্ষেত্র ও পরিধি বিবেচনায় এ জনবল যথেষ্ঠ নয়। নিরাপদ খাদ্যের তদারকি কার্যক্রমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বিএসটিআইয়ের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে দেশের ৩১৯টি পৌরসভা ও ১১টি সিটি কর্পোরেশনে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৩৭০টি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৭৮ জন কর্মরত আছে। অর্থাৎ বেশিরভার পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদ ফাঁকা রয়েছে। আবার সিটি কর্পোরেশনগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের স্বল্পতা লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ- জনসংখ্যারভিত্তিতে দেশের বৃহৎ ৩টি সিটি কর্পোরেশনের (ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) স্যানিটারি ইন্সপেক্টর সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন মাঠ পর্যায় থেকে মানুষের রান্নাঘরে ঢোকা পর্যন্ত যে বিশাল সরবরাহ নেটওয়ার্ক সেখানের প্রতিটি জায়গাতে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। কৃষক মাঠে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, এন্টিবায়োটিক এবং ভেজাল সার ব্যবহার করছেন। এ মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষককে সচেতন করে তোলার যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। আবার ভেজাল সার আমদানি বন্ধেও কঠোরতা নেই। উৎপাদন পর্যায়ের পর সরবরাহ পর্যায়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, ফরমালিনের মতো বিভিন্ন নিষিদ্ধ রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। ফলে নিরাপদ খাদ্য মানুষের কাছে দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। অনিরাপদ বিষাক্ত খাদ্য মানুষের শরীর সহ্য করতে না পারায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুস্তাক হোসেন বলেছেন, আমরা বিভিন্ন সময় পরীক্ষা করে দেখেছি কীটনাশকের প্রভাবে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। দিনাজপুর, ধামরাই এবং আত্রাইতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে পেটের পীড়ার মতো সমস্যা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তার শরীরে মারাতœক সমস্যা সৃষ্টি হয়। স্বাসতন্ত্র এবং লিভার আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যান্সার পর্যšন্ত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, কেমিক্যাল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুমোদিত রাসায়নিক এবং মাত্রা মেনে ব্যবহার করতে হবে। তবে সব থেকে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে অনঅনুমোদিত কীটনাশক এবং রাসায়নিক ব্যবহার করা। ড. মুস্তাক মনে করেন খাদ্যের উৎপাদন পর্যায় থেকে সরবরাহ সবক্ষেত্রেই যথাযথ নিয়ম না মানলে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কোন অবস্থাতে কমবে না। তিনি আরো বলেছেন, ফল-ফসলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ানোর দায় কৃষি বিভাগের। কারণ কৃষিতে কী ধরনের কীটনাশক-বালাইনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে তা দেখভালের দায়িত্ব তাদের। এ ক্ষেত্রে তাদের আইন আছে, কর্তৃপক্ষ আছে। যদি ওই আইনের আওতায় নিয়মমাফিক কীটনাশক-বালাইনাশক কিংবা সার প্রয়োগ করা না হয়, যদি এসবের যথেচ্ছ ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাহলে এ বিষয়ে তাদের দিক থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এদিকে কেবল 'ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ' প্রকল্পের মাধ্যমেই নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে এর আগে ২০১২ সালে পাঁচ হাজার ৩১২টি খাবারের নমুনা পরীক্ষা করে এর মধ্যে দুই হাজার ৫৫৮টিতেই বা ৪৯ শতাংশে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বা ভেজালকারী উপাদান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গবেষণায়ও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন খাদে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাছে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত এবং মাত্র ১০ শতাংশ বিষাক্ত নয়। আর কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ শতাংশই জমিসংলগ্ন জলাশয়ের পানিতে মেশে। এ ছাড়া ওই কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা উপকরণ পরিষ্কার করতে গিয়ে আরো কিছু কীটনাশক পুকুর বা নালার পানিতে চলে যায়। এতে একদিকে যেমন সরাসরি মাছ ও মাছের ডিমের ওপর ক্ষতিকর প্র্রভাব পড়ে, অন্যদিকে পানিতে থাকা মাছের খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটন (উদ্ভিদকণা) ও জুপ্লাংকটন (প্রাণিকণা) তাৎক্ষণিক মরে যায়। ফলে জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাছের খাদ্য নষ্ট হয়, পানি নষ্ট হয়। আবার মাছ থেকে তা মানবদেহে চলে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেছেন, ডিডিটি, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, কার্বামেট, আর্সেনিক, সীসা- সবই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে খাদ্যজাত কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এখন দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্তত কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল এবারকার গবেষণায়ই নয়, এর আগেও আইইডিসিআরসহ বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশে বিভিন্ন খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তিনি জানান, খাদ্যে যেসব রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তাতে পাকস্থলী, কিডনি ও লিভারের রোগ এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার 'ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ' কার্যক্রমের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেছেন, 'সবাই চায় নিরাপদ খাদ্য। কিন্তু এটা নিয়ে এত দিন তেমন কোনো কাজ ছিল না। এ ক্ষেত্রে যেসব সিস্টেম বিদ্যমান, তাও দুর্বল। রাজনৈতিক বা সামাজিক অঙ্গীকারও তেমন ছিল না। তবে বর্তমান সরকারের দিক থেকে নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট আছে বলেই নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ করা হয়েছে। এখন এই আইনের আওতায় বিধিমালা প্রণয়ন ও র্কর্তৃপক্ষ তৈরির মাধ্যমে আইন প্রয়োগ শুরু হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করি।' ওই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল আইনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না। এমন ইস্যুতে জনসচেতনতাও বড় ফ্যাক্টর। তাই সামাজিকভাবে খাদ্যে ভেজাল ও বিষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। বিএসটিআই’র বক্তব্য ঃ - শুধু দেশীয় ফল নয় অভিযানে দেখা গেছে বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে যেসব ফল বাজারে বিক্রি হয় সেসব আপেল, আঙ্গুরেও রয়েছে ফরমালিনের উপস্থিতি। সারাবছরই ফলকে তাজা রাখতে ফরমালিনের চেয়ে উপাদেয় ব্যবসায়ীদের কাছে আর কিছু নেই। অথচ আমাদানি পর্যায়ে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যে গুণগতমান পরীক্ষার জন্য আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে এনবিআরকে এ বিষয়ে দেখভালের কথা বলা হয়েছে। এর পরও বিদেশ থেকে আসা ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে ফলমালিনসহ অন্য রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এ বিষয়ে বিএসটিআই বলছে, কারা কিভাবে বিদেশী এসব ফলে ফরমালিন মেশাচ্ছে তার কোন সঠিক তথ্য না পাওয়ায় এর বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশ থেকে আমাদানি হয়ে আসা কার্টুন পরীক্ষা করেও আঙ্গুর ফলে ফরমালিন পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আসা এসব সামগ্রী বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের কোন ছাড়পত্র নিতে হয় না। ফলে কারা কিভাবে ফরমালিন মেশাচ্ছে তা বের করাও বিএসটিআইয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তারা বলছেন, এনবিআর থেকে যদি কাস্টমস পর্যায়ে এসব পণ্যের গুণগতমান পরীক্ষা করা হতো তাহলে বিষয়টি ধরা যেত। জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বিদেশী ফলমূল দেশে আসার পর কাস্টমস ছাড়পত্র নিয়ে সরাসরি কোল্ডস্টোরেজগুলোতে রাখা হয়। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন পাইকারী আড়ত হয়ে খুচরা বাজারে চলে আসে এসব ফলমূল। কিন্তু আমদানি হয়ে আসার পর গুণগতমান পরীক্ষা না করায় কখন, কারা কিভাবে এতে ফরমালিন মেশাচ্ছে তা সহজে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, প্রথমে ২০০৫ সালে বিএসটিআই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় ফরমালিনের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগে বাংলাদেশে ওই অর্থে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিতও হয়নি। বিশুদ্ধখাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯ সংশোধন করে ২০০৫-এ বিএসটিআইকে খাদ্যে ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। তখনই দেখা যায় দেশের খাদ্যে ব্যাপকভাবে ফরমালিন ব্যবহার হচ্ছে। ফরমালিন ও ভেজালমুক্তির জন্য দেশের প্রচলিত আইন ঃ Ñ সাধারণ জনগণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁিকতে রয়েছে দেশের শিশুরাও (যাদের বলা হচ্ছে আগামী দিনের নাগরিক)। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সকলের জন্য উদ্বেগজনক এবং আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে তাতে করে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুতগতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ এসব বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ কোন সরকারের পক্ষ থেকেই তেমন কোন কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড এন্ড ড্রাগ প্রশাসন’ বা এ ধরনের কোন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির চারবছরেও খাদ্যে ভেজালরোধে সারা দেশে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। যেন জনস্বাস্থ্যের কথা কেউ চিন্তা করছেন না। খাদ্যে ভেজালরোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন সরকারের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। অথচ এর মাধ্যমে দূরদর্শিতার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রতিবছর ১৫ মার্চ এলে ঘটা করে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়। সারা দেশ যখন ভেজালযুক্ত খাদ্যে ভরে গেছে, তখন এমনি এক পরিস্থিতিতে কনজ্যুমার রাইটস সোসাইটি ও কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব ??

সম্পর্কিত সংবাদ

গাজা  প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী ওয়ার্সির পদত্যাগ

আন্তর্জাতিক

গাজা প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী ওয়ার্সির পদত্যাগ

শাহজাদপুরের কায়েমপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদককে কুপিয়ে ও জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা

শাহজাদপুরের কায়েমপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদককে কুপিয়ে ও জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা

সিরাজগঞ্জে ভূয়া সার্জেন্ট গ্রেফতার

আইন-আদালত

সিরাজগঞ্জে ভূয়া সার্জেন্ট গ্রেফতার

চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় নাঈমুল হাসান রনি (৩০) নামের...

উল্লাপাড়ায় নছিমন উল্টে বউ শ্বাশুড়ি নিহত, আহত ৭