বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
শামছুর রহমান শিশির : ‘কত কষ্ট কইরা আমি,ইটা দিয়া পাথর ভাঙ্গি-তবুও কারোর (বুড়োর) মন পাইলাম না রে!’-সুফিয়া খাতুনের এ বাস্তবমুখী গানের মতো শাহজাদপুরের অর্ধ লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিকেরা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর একটানা পরিশ্রম করেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রবমূল্যের উর্ধগতি আর মহাজন কর্তৃক প্রাপ্য মজুরী প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বি মূল্যবৃদ্ধি, নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার কাঁচামাল ও উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, চালের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে এবং উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে বেঁচাকেনায় চরম মন্দাভাব, বিভিন্ন এনজিও, সুদখেকো সুদ ব্যবসায়ী, সমিতি ও ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা বহন, ক্রয়-ক্ষমতা হ্রাস, তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের নায্য মজুরি প্রাপ্তি বঞ্চিতসহ নানাবিধ কারনে ওইসব শ্রমিকদের ভাগ্যাকাশে বর্তমানে বিরাজ করছে কালো মেঘের ঘনঘটা । দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প ঐহিত্যবাহী তাঁতশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির জন্য ও তাদের ভাগ্যোন্নয়নের চিন্তা-ভাবনা, সুষ্ঠু পরিকল্পনাসহ ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তার অভাবে ওই দুর্যোগ-দুর্ভোগ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এ ব্যপারে ওইসব ভাগ্যবিড়ম্বিত চির অবহেলিত,চির পতিত,চির অপাংক্তেয় হৎদরিদ্র শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি বলে স্থানীয় শ্রমিদের উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না বলে স্থানীয় তাঁত শ্রমিক নেতৃবৃন্দ্র আক্ষেপ প্রকাশ করে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যেই বন্যা ও বর্ষণসহ নানাবিধ কারনে এলাকার প্রায় ৩৫ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। স্থানীয় তাঁত শ্রমিক নেতাদের ভাষায় শাহজাদপুরে তাঁতশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত মোট তাঁত শ্রমিকের অর্ধাংশই আজও চরম অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। দিনভর মেহনতি এসব শ্রমিকদের বুক ফাঁটেতো আজও মুখ ফোঁটেনা। ওদের ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদছে। বিশাল এ জনগোষ্ঠি চায় দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খাবার নিশ্চয়তা, চায় পরিবার পরিজন নিয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকতে, চায় মেহনত করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু ওদের ওই চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করার, ওদের পাশে একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে তেলের মাথায় তেল দেওয়ার প্রবণতা বেশী পরিলক্ষিত হওয়ায় ওইসব শ্রমিকরা সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত হওয়ায় জীবনজীবিকার প্রশ্নে চরম অনিশ্চয়তায় উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় বর্তমানে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছে। শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি তাঁতী ওমর ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক আল-মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘বৃষ্টি-বন্যাসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতিতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যায় বৃদ্ধি, নায্য মজুরি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত, ঋনের কিস্তির ঘানি টানাসহ বহুবিধ কারণে শাহজাদপুর উপজেলায় কর্মরত প্রায় সকল তাঁতশ্রমিকই অতিকষ্টে মানবেতর দিনযাপন করছে। ইতিমধ্যেই পুঁজি সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত কারণে শাহজাদপুরের প্রায় ৩৫ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। ফলে তাঁতীদের অবস্থা আরও করুণ হবার পাশাপাশি এর সরাসরি প্রভাব শ্রমিকদের ওপর পড়ায় খেয়ে না খেয়ে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, দুর্গতিতে নিমজ্জিত হয়ে শ্রমিকদের মানবেতর ভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে।’ শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র শাহজাদপুরেই রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার তাঁত শ্রমিক। এদের মধ্যে স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যা ৪২ হাজার। আর শাহজাদপুরের বাইরে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়ির এলাকার তাঁত শ্রমিক এখানে নিযুক্ত রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার । ওইসব হাজার হাজার শ্রমিকের গড় আয় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। বর্তমানে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতিতে বর্তমান আয় দিয়ে জীবন চালানো খুবই মুশকিল হয়ে পড়েছে। এমন অনেক শ্রমিক রয়েছেন যাদের ওপর পুরো পরিবারই ওই একজন শ্রমিকের আয়ের ওপর পুরোপুরি নীর্ভরশীল। এসব শ্রমিক পরিবারের বর্তমানে কিভাবে দিন কাটছে তা পল্লী এলাকায় গিয়ে নিজে চোখে না দেখলে বোঝা যাবেনা। এ বিশাল জনগোষ্ঠি শ্রমিকের সিংহভাগই ‘দিন আনি দিন খাই’-এ নীতিতে চলছে। কোন দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে তাদের কাজ বন্ধ থাকলে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে একবেলা বা উপোষ করে দিন কাটাতে হয়। ফলে ওইসব শ্রমিকেরা পুঁজি ভেঙ্গে, সম্পদ বিক্রি করে, ধারদেনা করে বিশেষ করে স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে কোনভাবে দিন অতিবাহিত করছে। এতে, তাদের ধারদেনা ও ঋণের মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতিটি দিনে প্রতিটি ক্ষণে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূলের আকাশচুম্বি উর্ধ্বগতিতে এমনিতেই ওদের বেহাল অবস্থা ,তার পরেও ‘মরার ওপার খাড়ার ঘা’এর মতো ঋণের কিস্তি টানতে টানতে ঋণ শোধের পরিবর্তে নতুন করে আরও বিভিন্ন এনজিওর ঋণের অধৈ জলে আটকে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে আর হা-হুতাশ করছে। ফলে স্থানীয় তাঁত শ্রমিক অফিসে বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিদের আগমন ও শ্রমিকদের কাছে পাওনা টাকার বিচার চাওয়ার প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে, তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের কাঁচামালসহ সকল প্রকার উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদিত কাপড়ের উৎপাদন ব্যায় বেড়েছে। কিন্তু কাপড়ের উৎপাদন ব্যায়ের সাথে মুনাফা যোগ করে কাপড়ের হাটে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্রের আশানুরূপ বিক্রি করতে না পারায় তাঁত শ্রমিকদের অনেক সময় মজুরি দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন তাঁত মহাজনেরা।এ মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব পুরোপুরি গিয়ে পড়ছে খেটে খাওয়া মেহনতী হাজার হাজার তাঁত শ্রমিকদের ওপর। হাটে উৎপাদিত কাপড় বিক্রি হলে তাঁতীরা কারখানার শ্রমিকদের স্বতস্ফূর্তভাবে মজুরি প্রদান করে থাকেন। কিন্তু বিক্রির অবস্থা নাজুক হলে শ্রমিক বিল আটকে যাওয়ায় শ্রমিকদের হয় খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিন যাপন করতে হয়, নতুবা ধারদেনা করে বাজার করতে হচ্ছে। বর্তমানে কাপড়ের হাটে উল্লেখযোগ্য বেচাবিক্রি না হওয়ায় তাঁতীরাও চোঁখে সর্ষের ফুল দেখছে। ফলে শাহজাদপুরে ঐহিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত বিশাল এ শ্রমিক জনগোষ্ঠির জনজীবন বিষিয়ে ও তেঁতো হয়ে উঠেছে।পক্ষাস্তরে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের প্রভাব হিসাবে শাহজাদপুরে বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ার লুমের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একজন তাঁত শ্রমিক দিনভর মেহনত করে যে পরিমান তাঁতবস্ত্র উৎপাদন করেন, পাওয়ার লুমে তার চেয়ে ৫/৬ গুন বেশী পরিমান তাঁতবস্ত্র উৎপাদিত হওয়ায় তাঁত শ্রমিকদের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে দিনে দিনে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শুধুমাত্র পাওয়ারলুমের সংখ্যা বৃদ্ধি জনিত কারণেই এলাকায় অসংখ্য শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। আবার অনেকেই ন্যায্য মজুরি না পেয়ে অন্য পেশায় ঝূঁকছে। ফলে সার্বিকভাবে শাহজাদপুর উপজেলার প্রায় অর্ধলক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দুঃর্বিসহ জীবন যাপন করলেও দেখার কেউ নেই! শাহজাদপুরের বিসিক এলাকায় স্থাপিত বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড স্থানীয় তাঁতী ও তাঁত শ্রমিদের ভাগ্যেন্নয়নে কতটুকু কাজে আসছে তা নিয়ে তাঁতী ও তাঁত শ্রমিকদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে।

সম্পর্কিত সংবাদ

গাজা  প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী ওয়ার্সির পদত্যাগ

আন্তর্জাতিক

গাজা প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী ওয়ার্সির পদত্যাগ

সিরাজগঞ্জের শ্রেষ্ঠ সার্কেল অফিসার ফাহমিদা হক শেলী

ফটোগ্যালারী

সিরাজগঞ্জের শ্রেষ্ঠ সার্কেল অফিসার ফাহমিদা হক শেলী

শাহজাদপুর সংবাদ ডটকম, বিশেষ প্রতিবেদক, বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বও ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ : সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় সন্মেলন ক...

শাহজাদপুরে ভূমি সপ্তাহ শুরু

শাহজাদপুরে ভূমি সপ্তাহ শুরু

ভূমি সংক্রান্ত নাগরিক সেবা আরও জনমুখী, তথ্য প্রযুক্তি নীর্ভর ও গ্রাহক বান্ধব করে তোলার লক্ষে গতকাল শনিবার উপজেলা ভূমি অফ...

ফলোআপ:-শাহজাদপুরে পোরজনা ইউপি চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষের দুর্ণীতির সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যমকে সাধুবাদ

অপরাধ

ফলোআপ:-শাহজাদপুরে পোরজনা ইউপি চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষের দুর্ণীতির সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যমকে সাধুবাদ

শামছুর রহমান শিশির, নিজস্ব প্রতিবেদক, শাহজাদপুর : গত সোমবার সিরাজগঞ্জ থেকে প্রকাশিত, বহুল পঠিত, পাঠক প্রিয়, নন্দিত অনলাই...

শাহজাদপুরে ছেলেকে অপহরণ ও ব্যবসায়ীকে হত্যার হুমকি দিয়ে ২লাখ টাকা চাঁদা দাবী ৩ অপহরণকারী আটক

আইন-আদালত

শাহজাদপুরে ছেলেকে অপহরণ ও ব্যবসায়ীকে হত্যার হুমকি দিয়ে ২লাখ টাকা চাঁদা দাবী ৩ অপহরণকারী আটক

আজ রোববার শাহজাদপুরে চাঁদাবাজও অপহরণকারী চক্রের ৩ সদস্যকে পুলিশ আটক করে। এরা হল, উপজেলার...