মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
২৪ এপ্রিল উল্লাপাড়া ঘাটিনা ব্রীজে প্রতিরোধ যুদ্ধ// ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ শহর মুক্ত ছিল 4 আবুল বাশার ঃ ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল উল্লাপাড়া রেল ষ্টেশনের প্রায় ১ কিলোমিটার পূর্বে ফুলজোড় (করতোয়া) নদীর ওপর স্থাপিত ঘাটিনা ব্রীজে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবানিীর প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল। পূর্বে ১৯’এপ্রিল ডাববাগানের প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও আতœহুতির পর মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর তারা জেলার বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহন করে। এরই অংশ হিসেবে সড়ক পথে পাকবাহিনী যেন বগুড়ার দিকে যেতে না পারে সেজন্য বাঘাবাড়ী বড়াল নদীর উত্তরপাড়ে স্থানীয় জনগনের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি বাংকার খুঁড়ে সেখানে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। পাশাপাশি রেল পথে (ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ) পাকবাহিনী যাতে সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য উল্লাপাড়া রেল ষ্টেশন থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পূর্বে ফুলজোড়(করতোয়া) নদীর ওপর স্থাপিত ঘাটিনা ব্রীজের পূর্বপাড়ে শাহজাহানপুর গ্রামের আশে পাশে নানা স্থানে বাঙ্কার ঘুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ডাববাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার পর থেকেই পাকবাহিনী বগুড়ারর দিখে অগ্রসর হওয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করে। মানবতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী নানা অপকর্মের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মামলার আসামি সে সময়ের ছাত্রসংঘের নেতা বর্তমানে জামাতে ইসলামির সেক্রেটারী জেনারেল নিজামির বাড়ী সাথিয়া উপজেলায়। পাকবাহিনী নিজামী গংদের সহায়তায় পাবনা শহর দখল নেয়ার পর থেকেই হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা আটতে থাকে। সকল থানা শহরের স্বাধীনতা বিরোধী দালালেরা এক অপরের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলে। তারা পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে। এভাবে সকল প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে পাকবাহিনী ২২ এপ্রিল বাঘাবাড়ীর বড়াল নদীর দক্ষিণপাড়ে পেঁছে যায়। তখন বড়াল নদীর উত্তর পাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার খুড়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মহুকূমা প্রশাসক সামসুদ্দিন ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের পরামর্শে এ প্রতিরোধ ব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎসময়ে সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্রীলগের নেতা প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জা সহ শাহজাদপুর কলেজের ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় জনগণ। ২২ এপ্রিল বিকেলের দিকে নদীর ঘাটে পৌঁছেই পাকবাহিনী নদীর উত্তর পাড়ের গ্রামের বিভিন্ন টারগেট লক্ষ্য করে মর্টার সেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এর পাশাপাশি উত্তরপার লক্ষ্য করে বারবার মেশিনগান গুলি চালানো শুরু করে। এদিকে ডাববাগান যুদ্ধে আহত ও নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিনতি দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। পাকবাহিনীর মর্টার সেল নিক্ষেপ মেশিনগানের ব্যাপক গুলি চালাননোর তৎপরতায় বড়াল নদীর উত্তরপাড়ে প্রতিরোধে থাকা মুক্তিযোদ্ধা হতভম্ব হয়ে পরে। কোনরুপ প্রতিরোধ করা ছারাই তারা বড়াল নদীর উত্তরপাড়ের তাদের অবস্থান ছেরে দিয়ে গ্রামের দিকে পিছু হটে। এদিকে ঐ মর্টার সেল ফাটার শব্দ ও গুলির শব্দে শাহজাদপুর থানা সদরে বসবাসরত মানুষেরা প্রাণভয়ে করতোয়া নদী পার হয়ে নদীর পূর্বপাড়ের দিকে হাজার হাজার নারী পুরুষের দল পালাতে থাকে । একদিকে প্রাণভয়ে শিশুর আতœচিৎকার অপরদিকে ব্যাগ-পেটরা, পুটলির বোঝা মাথায় কিম্বা কোমরে তুলে নারী-পুরুষের দল পালাতে শুরু করে। রাতের মধ্যেই শহর অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। শহরে থাকে সুবিধাবাদী একশেনীর ধান্দাবাজ মানূষ। তারা অনেকেই ফাঁকা বাড়ীর মালামাল লুটপাটে অংশ নেয়। পাকবাহিনী প্রতিরোধ না পাওয়ায় তারা নদীর দক্ষিণপাড়ে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরী করে। নদী পার হওয়ার কৌশল খুজতে থাকে তারা। দালালরা ফেরী আনার ব্যাবস্থা করে। স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় ২৩ তারিখ ভোরে পাকবাহিনী শাহজাদপুরে ঢুকে পরে। শাহজাদপুরে ঢুকেই তারা প্রথমে দ্বারিয়াপুর বাজোরের ব্রজগোপাল বসাকের কাপড়ের দোকানে আগুন ধড়িয়ে দেয়। এ ছারাও বাজারের নারায়ন পোদ্দার,মনি পোদ্দার,রামগোবিন্দ পোদ্দার, দেবেন পাল, খগেন পাল বাঘাবাসীর দোকান সহ বাজারের প্রায় সিংহ ভাগ দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়। আগুন দিতে দিতে পাকবাহিনী বলতে থাকে ‘লুটলেও বাঙাল, লুট লেও, পাকবাহিনীর সহযোগি দালালরা এ লুটের কাজে অনেকেই লিপ্ত হয়। এরপর তারা মনিরামপুর গ্রামে ও সাহাপাড়ায় ঢুকে ব্রজগোপাল বসাক, প্রান গোপাল সাহার মন্দির, আওয়ামীলীগ নেতা আবুতাহের ও ফরহাদ মিয়া, রামকানাই পোদ্দার রামগোবিন্দ পোদ্দার সহ আরো অনেক বাড়ীতে আগুন ধড়িয়ে দেয়। এর পর সৈয়দ হোসেন মনছুর তারা মিয়ার(আওয়সীলীগ থেকে নির্বাচিত এম এন এ) বাড়ীতে গিয়ে তাঁর বৈঠকখানা ঘড়ে আগুন ধড়িয়ে দেয়। এরপর পাকবাহিনী আবার বাঘাবাড়ী ফিরে যায়। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় অনেনেকেই ভারতে চলে যায়। কেউ ভারতের উদ্যেশে রওনা হয়। অন্যরা গা ঢাকা দেয়। শুধুমাত্র ছাত্রজনতার নেতৃত্ব কোনরকমে প্রতিরোধ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। এদিকে প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ শহর পাহানাদারমুক্ত রাখার কৌশল হিসেবে উল্লাপাড়া রেল ষ্টেশন সংলগ্ন করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত রেলের ঘাটিনা ব্রীজের রেলের স্লীপার তুলে ফেলে। ব্রীজের পূর্বপাড়ে শাজাহানপুর গ্রাম এলাকায় বিভিন্ন স্থানে বাংকার খুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা এর আগেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। শাজাহানপুর বটতলা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা ও প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ননায় জানাযায়, ২৪ এপ্রিল পাকবাহিনী বাঘাবাড়ী থকে বগুড়ার দিকে মুভ করে। তারা রাস্তার বিভিন্ন বেরিকেড সড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসার পথে গাড়াদহ গ্রামে আগুন দেয়। ঘাটিনা ব্যীজের পূর্বপাড়ে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা সেটি দেখতে পায়। তারা প্রস্তুতি নিয়ে ওত পেতে থাকে। অপরদিকে বগুড়া থেকে পাকবাহিনীর কয়েকটি জীপ ও লোরী উল্লাপাড়া রেল ক্রসিং এ পৌঁছে যায়।এ সময় তারা ৪/৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। কোনরুপ প্রতিরোধ না পেয়ে পাকবাহিনী হাটাহাটি করে উল্লাপাড়া তেল পাম্পে যায়। এ সময় তেলপাম্পের পাশে একজনকে দৌড়ে পালাতে দেখে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা উল্লাপাড়া সদরের দিকে এগুতে থাকে। এমন সময় ঈশ্বরদীর দিক থেকে আসা সামনে মালবগি লাগানো একটি ট্রেন উল্লাপাড়া রেল ষ্টেশনে ঢুকে পরে। ঐ ট্রেনে পাকবাহিনীর বহর লক্ষ্য করা যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ট্রেন নিয়ে পাকবাহিনীর দলটি সিরাজগঞ্জের দিকে এগুতে থাকে। পথে ঘাটিনা ব্রীজের রেল স্লীপার তোলা দেখে ১০/১২ জনের পাকবাহিনীর একটি দল ব্রীজের আবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ব্রীজের মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। এসময় ওতপেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান, রাইফেল থেকে অনবরত গুলি চালাতে থাকে। প্রথম দফাতেই ব্রীজ দেখতে আসা পাকবাহিনর দলটি গুলি খেয়ে নদীর পানিতে পরে যায়। এদিকে ট্রেনে থাকা পাকবাহিনীর অন্যন্য সদস্যরা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পজিশন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বৃষ্টির মত গুলি চালাতে থাকে। ঐ গোলাগুলির শব্দে শাহজাহানপুর ও আশেপাশের লোক গ্রাম ছেরে পালাতে থাকে। এদিকে ক্রমাগত পাকবাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে মার্টার থেকে সেল নিক্ষেপ করতে থাক। ঐ যুদ্ধে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়। একঘন্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে সলপের দিকে চলে যায়। সলপের বিভিন্ন গ্রামে তারা অবস্থান নেয়। পরেরদিন সকাল ১০ টার দিকে পাকবাহিনী দালালদের সহায়তায খেয়া নৌকায় পার হয়ে শাহজাহানপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। শাহজাহানপুর কামার পাড়ায় গ্রামের দুই শতাধিক বাড়ীতে আগুন দেয়। এরপর দালালদের সহায়তায় তারা গ্রাম থেকে মানুষ ধরে নিয়ে এসে রাস্তা তৈরী করে গাড়ী চলাচলের জন্য । পালা করে গ্রামবাসীকে ব্রীজ পাহারার কাজে লাগায়। প্রতিদিন বিভিন্ন যায়গা থেকে লোক ধরে নিয়ে এসে ব্রীজের ওপর থেকে গুলি করে, বেওনেট চার্জ করে মৃত লাশ নদীর পানিতে ফেলতে থাকে। ২৬ এপ্রিল তারা রেলের স্লীপার ঠিক করে ট্রেন নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের দিকে এগুতে থাকে। নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে ২৭ এপ্রিল ট্রেন নিয়ে পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকে পরে। সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনরুপ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা তখন শহর ছেরে বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় ছড়িয়ে পরে। তারা যুদ্ধের নতুন কৌশল খুঁজতে থাকে । একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ প্রশিক্ষণ ও ভারী অস্ত্রসংগ্রহের জন্য ভারতে পারি জমায়। এরপর গাড়ল গাতি ও কানসোনা গ্রামে ঢুকে পাকবাহিনী বহু মানুষকে হত্যা করে গ্রামের বাড়ীঘড় পুড়িয়ে দেয়। এভাবে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্ত ছিল।

সম্পর্কিত সংবাদ

বগুড়ায় ৬ টাকায় এক কেজি কাঁচা মরিচ

বাংলাদেশ

বগুড়ায় ৬ টাকায় এক কেজি কাঁচা মরিচ

চাষিরা বলছেন, খেত থেকে হাটে নেওয়া পর্যন্ত প্রতি কেজি কাঁচামরিচে গড়ে তিন টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া রয়েছে খাজনা ও অন্যান্য খরচ,...

হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাড়িতে করোনা রোগী

বাংলাদেশ

হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাড়িতে করোনা রোগী

কুমিল্লার লাকসামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসলেশনে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্ত এক রোগী গোপনে পালিয়ে বাড়িতে চলে যাওয়ার অভ...

সাংবাদিক শামছুর রহমান শিশিরের নানীর ইন্তেকাল

সাংবাদিক শামছুর রহমান শিশিরের নানীর ইন্তেকাল

আমরা অত্যন্ত গভীর শোকাহত অবস্থায় জানাচ্ছি ‍যে, সাংবাদিক মো. শামসুর রহমান শিশির এর নানী ও মরহুম কুতুব উদ্দিন মোল্লার স্ত্...