বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
শামছুর রহমান শিশির : আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেঁত শিল্প কালের আবর্তে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশপট থেকে। সারাদিন কলুর বলদের মতো খেটে বিভিন্ন ধরনের সুদৃশ্য দ্রবসামগ্রী তৈরি করেও বর্তমানে আধুনিক যুগে তৈরিকৃত বিভিন্ন ধরনের ধাতব শিল্পের আগ্রাসনের কবলে পড়ে বাঁশ ও বেঁতের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম শিল্পটি ক্রমশঃ মুখ থুবড়ে পড়ছে। অতীতে বাঁশ ও বেঁত দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, মাছ ধরার চাঁই, ঝুঁড়ি, আরাম কেদারা,সোফাসেট, বইপত্র রাখার তাকসহ বিভিন্ন ধরনের পন্য সামগ্রীর দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা ও প্রচলন থাকলেও বর্তমানে ওইসব সামগ্রীর কদর প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ফলে শাহজাদপুরসহ আশেপাশের এলাকায় কর্মরত শত শত বাঁশ ও বেঁত শিল্পীদের জীবনে বর্তমানে নেমে এসেছে দুর্যোগের কালো মেঘের ঘনঘটা। বাঁশ ও বেঁত দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি উৎপাদন করেও তা ন্যায্যমূল্যে বাজারে বিক্রি করতে না পেরে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী ওই প্রাচীনতম শিল্পটির চরম দুর্দিন চলছে। ফলশ্রুতিতে ওই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শত শত শিল্পীদের ঘরে ঘরে অভাব অনটন লেগেই আছে । দৈনিক আয় খুবই কম হওয়ায় ওইসব শত শত শিল্পীরা তাদের পরিবারের ভরণপোষনের প্রশ্নে চোখে সর্ষের ফুল দেখছে। ফলে প্রতিটি দিন ওইসব ভাগ্যবিড়ম্বিত শিল্পীদের খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। শাহজাদপুর পৌরসদরের পাঠানপাড়া ও রূপপুর গ্রামের কয়েকজন বাঁশ বেঁত শিল্পীদের সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। আলাপকালে তারা জানান,প্লেনশিটসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ দিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের দ্রবাদির স্থায়ীত্ব দীর্ঘজনিত কারণে বাঁশ ও বেঁত দিয়ে তৈরি দ্রব্যসামগ্রী চাহিদা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তদস্থলে প্লেনশীট, লোহাসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহারের মাত্রা পুরোদমে প্রচলিত থাকায় ঐতিহ্যবাহী ওই শিল্পটি বর্তমানে তোপের মুখে রয়েছে। বাঁশ বেত শিল্পীদের ভাষ্যমতে, ‘বর্তমানে রংপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বাঁশ আমদানীতে আন্ত:পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া বাঁশের উৎপাদন হৃাস ও দুঃপ্রাপ্যতাজনিত কারণে বর্তমানে ছোট ছোট একেকটি বাঁশ ১ শ’ ৮০ টাকায় কিনে আনতে হচ্ছে। অতীতে বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শৌখিন সামগ্রী তৈরি হলেও বর্তমানে খলপার বেড়া ও চাটাই তৈরি করা হচ্ছে। দিনে যে টাকা আয় হচ্ছে তা দিয়ে বর্তমানের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর আকাশচুম্বি মূল্যজনিত কারনে পরিবারের ভরণপোষন করতে খুব কষ্ট করতে হচ্ছে। শাহজাদপুর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী কাজিপুর, বেলকুচি, কামারখন্দ, চৌহালী এবং পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, বনওয়ারী নগর ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া এলাকার গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত বাঁশ দিয়ে খলপার বেড়া ও চাটাই তৈরি করা সম্ভব না হওয়ায় এসব এলাকার বাঁশকে ঘরের খুটি, পাঁকা ইমারত তৈরির সময় শার্টারের নীচের খুঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।এই জনপদে উৎপাদিত একেকটি বাঁশ আকার ও প্রকারভেদে ২শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উচ্চমূল্যে ক্রয় করে সামগ্রী বিক্রিতে প্রাপ্য অর্থ না পাওয়ায় সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর মেহনত করেও পরিবারের সদস্যদের তিনবেলা পেটপুরে আহারের যোগান দেওয়াই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এতে বাঁশ বেঁত শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অনেক মহাজনই লোকসানের ভার সইতে না পেরে ঐতিহ্যবাহী এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। আর এই এলাকার শত শত শিল্পীরা উপযুক্ত পরিশ্রম করেও স্বল্প আয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে তাদরে জীবনজীবীকার প্রশ্নে চরম অনিশ্চয়তা নেমে আসায় পেশা বদলজনিত কারণে এ পেশায় সম্পৃক্ত শিল্পীদের সংখ্যা ক্রমাগত হৃাস পাচ্ছে।’ জানা গেছে, রংপুর থেকে আমদানীকৃত ১শ’৮০ টাকা পিছপ্রতি বাঁশ কিনে এসে খলপার বেড়া তৈরি করা হচ্ছে। বাঁশের উপরিভাগের অপেক্ষাকৃত টেকসই অংশ দিয়ে তৈরি খলপা শাহজাদপুরসহ পাবনা সিরাজগঞ্জের বাজারে হাতপ্রতি প্রায় ৭০ বা কিছু কমবেশী মূল্যে টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর বাঁশের ভিতরের অংশ দিয়ে তৈরি অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ীত্বের খল্পা হাতপ্রতি প্রায় ৫০ বা কিছু কম বেশী টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি বাঁশ কিনে আনার পর দিনভর মেহনত করে খলপার বেড়াসহ অন্যান্য বেশকিছু বাঁশজাত সামগ্রী প্রস্তুত করা হলেও উৎপাদন ব্যয়ের সাথে কিছু মুনাফা যোগ করে বাজারে বিক্রি করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে সার্বিকভাবে শাহজাদপুরসহ এর আশেপাশের এলাকার ঐতিহ্যবাহী ওই প্রাচীন শিল্পটি কালের আবর্তনের সাথে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। এদিকে,শাহজাদপুরসহ আশেপাশের বেঁত ঝাঁড় উজার করে বসতভিটা তৈরি করায় বেঁতের দুঃ¯প্রাপ্যতাও দিন দিন বাড়ছে । ওইসব এলাকায় বেঁতের ঝাঁড় আর সচারচার দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া আশানুরূপ লাভজনক না হওয়ায় ওই শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের দিনদিন তীব্র পুঁজি সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি বাজারে উচ্চদামে বাঁশ ও বেঁত ক্রয় করে বিভিন্নধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করে বাজারে উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে না পেরে তারা পড়ছে মহাবিপাকে। জনসংখ্য বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট আবাসনজনিত সম্যসার সমাধান জনিত কারণে শুধু শাহজাদপুরেই নয়, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, বেলকুচি, কামারখন্দ, চৌহালী এবং পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, বনওয়ারী নগর ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া এলাকায় অতিরিক্ত বসতভিটা তৈরি করায় গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য বেঁত ও বাঁশঝাঁড় কেটে উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। ফলে অতীতের মতো বাঁশ ও বেঁতের ঝাঁড়ের সংখ্যা বর্তমানে বৃদ্ধি না পেয়ে হৃাস পাচ্ছে। শাহজাদপুরসহ এর আশেপাশের এলাকায় একদিকে যেমন বাঁশ ও বেঁতের উৎপাদন কমে যাচ্ছে,অন্যদিকে আবহ গ্রাম বাংলার ঐহিত্যবাহী সুপ্রাচীন ওই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শত শত শিল্পীরা অভাব অনটনে পড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে। তাদের ভাষ্যমতে, আবহ গ্রাম বাংলার ধারক বাহক ঐহিত্যবাহী বাঁশ বেঁত দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, ঝুঁড়ি , মোড়া, বইপুস্তক সাজিয়ে রাখার তাক, আরামকেদারা, সোফাসেটসহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশ ও বেঁতজাত সামগ্রী কালের বিবর্তনে দেশ থেকে ক্রমেই হারিয়ে গেলেও ওই ঐহিত্যবাহী শিল্পটি রক্ষায় কাউকেই কোন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা ওই ঐহিত্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখতে শত শত শিল্পীদের মধ্যে এখোনো অনেক ত্যাগ, কষ্ট, দুঃখ সহ্য করেও শিল্পটি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এভাবে বাঁশ ও বেঁতের ঝাঁড় উজাড় করার ফলে আর কতদিন ঐতিহ্যবাহী ওই শিল্পটি টিকে থাকবে তা নিয়ে তাদের মধ্যেই নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।

সম্পর্কিত সংবাদ

গাজা  প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী ওয়ার্সির পদত্যাগ

আন্তর্জাতিক

গাজা প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী ওয়ার্সির পদত্যাগ

শাহজাদপুরের কায়েমপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদককে কুপিয়ে ও জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা

শাহজাদপুরের কায়েমপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদককে কুপিয়ে ও জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা

সিরাজগঞ্জে ভূয়া সার্জেন্ট গ্রেফতার

আইন-আদালত

সিরাজগঞ্জে ভূয়া সার্জেন্ট গ্রেফতার

চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় নাঈমুল হাসান রনি (৩০) নামের...

উল্লাপাড়ায় নছিমন উল্টে বউ শ্বাশুড়ি নিহত, আহত ৭